ভারতীয় ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্র তবলাকে বিশ্বের আঙিনায় যারা পৌঁছে দিয়েছেন তাদের সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়। তাদের মধ্যেই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন গৌরীশঙ্কর কর্মকার। হুগলীর শ্রীরামপুরেই তার পৈতৃক বাড়ি। গৌরীশঙ্করের বাবা পন্ডিত শিবশঙ্কর কর্মকার, যিনি বাংলার প্রখ্যাত তবলিয়া। উস্তাদ কেরামতউল্লা খাঁয়ের এই সুযোগ্য শিষ্য ৯০ বছর বয়েসেও ছাড়েন নি তবলার সান্নিধ্য। গৌরীশঙ্কর কর্মকার মার্কিন মুলুকে তবলার জনপ্রিয়তাকে পৌঁছে দিয়েছেন শীর্ষে। তবে এই মুহূর্তে তিনি রয়েছেন মাস খানেকের ভারত সফরে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের দিকপাল ব্যাক্তিত্বদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি বাজাচ্ছেন তবলা। তারই ফাঁকে একদিন ‘এক্সক্লুসিভ অধিরথ’কে তিনি জানালেন তার সফরের কথা।
তবলায় আপনার হাতেখড়ি কীভাবে?
তবলায় আমার হাতেখড়ি আমার গুরু পণ্ডিত শঙ্খ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। মাত্র তিন বছর বয়েসে ওনার কাছে আমার হাতেখড়ি হয়।
কেন তবলা বাদনকেই পেশা হিসেবে নিলেন?
এটির মুখ্য কারণ আমার বাবা পন্ডিত শিবশঙ্কর কর্মকার। সঙ্গীতে উনি নিবেদিত-প্রাণ, তাই আমি ওনাকে সঙ্গীত-সাধক বলি। উনি আমাকে শিখিয়েছেন, সেই পরিবেশেই বড় হয়েছি। এটি শিখতে শিখতে কখন যে পেশায় ঢুকে গিয়েছি তা নিজেও জানিনা। মূলতঃ আলাদা করে লক্ষ্য ছিল না যে তবলা বাদনকেই পেশা করবো। বাবা চাইতেন আমি নিজেকে পেশাদার তবলিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। তাই এই পেশায় আমি এসেছি।
আপনি কি শুধুমাত্র ক্লাসিক্যাল আঙ্গিকেই বাজান? নাকি আধুনিক গানেও বাজান?
আমি মূলতঃ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছাত্র। সেভাবেই আমি নিজেকে গড়ে তুলেছি। আমি মনে করি অন্যান্য ধারার সঙ্গীতে বাজাতে গেলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখা অত্যন্ত জরুরী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়াও আমি ওয়ার্ল্ড ফিউশন প্রচুর বাজাই। আমি আফ্রিকার সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গেই পরিবেশন করেছি। বাংলা আধুনিক গানেও অনেক বাজিয়েছি। প্রত্যেকটি দিকই প্রয়োজন। সেটি শিখতে পারলে যে কোনও আর্ট-ফর্মে তা কাজে লাগে।
আপনি যদি তবলিয়া না হতেন, তাহলে পছন্দের দিক থেকে অন্য কোন বাদ্যযন্ত্র বেছে নিতেন?
আমার দ্বিতীয় পছন্দ সেতার। যদিও আমি এটি শিখে উঠতে পারিনি। তবে আমি প্রচুর সেতার বাদকের সঙ্গে বাজিয়েছি, বর্তমানে বাজাচ্ছিও। তবলার বাইরে যদি ধরা হয়, সেতার আমার যথেষ্টই ভালো লাগার একটি বিষয়।
মার্কিন মুলুকে আপনার হাতে প্রতিষ্ঠিত ‘স্কুল অফ ইন্ডিয়ান পারকাশন অ্যান্ড মিউজিক’ যথেষ্টই সাড়া ফেলেছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
‘স্কুল অফ ইন্ডিয়ান পারকাশন অ্যান্ড মিউজিক’ বা এসআইপিএমের জন্মলগ্ন ২০০৮ সাল। টেক্সাসের রাজধানী শহর অস্টিনে স্কুলটির অবস্থান। স্কুল প্রতিষ্ঠার আগেই সেখানে আমার অনেক ছাত্র ছিল। যেহেতু নিয়মিত সেই অঞ্চলে আমি পারফর্ম করতে যেতাম(১৯৯৬ থেকে)। তারপর নন-প্রফিট সংস্থা হিসেবে মর্যাদা পায় এই স্কুল। তবলা দিয়ে শুরু হলেও বেহালা বাজানোর প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রখ্যাত বেহালা-বাদক ইন্দ্রদীপ ঘোষ সেখানে যুক্ত হয়েছেন। বিগত সেমেস্টারে ৫৫ জন ছাত্রের মধ্যে অন্ততঃ ১৫ জন ভীষণ প্রতিভাবান। এরই মধ্যে ঋষি প্রসাদ বা অর্ণবের মতো কিছু ছাত্র রীতিমতো পেশাদার হিসেবে ইতিমধ্যেই কাজ করছেন। ২০২০ থেকে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সুযোগ্য শিষ্য ব্রজেশ্বর মুখার্জী আমাদের ফ্যাকাল্টিতে যোগ দিচ্ছেন। উনি ভোকালের দায়িত্ব নেবেন।
আপনার এই তবলিয়া জীবনে কোনও বড় প্রাপ্তির কথা জানান।
একসময় পরপর নয়টি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান জেতার কোথা কখনোই ভোলার নয়। সেই কারণে ‘বেস্ট ইয়ং তবলা প্লেয়ার অফ বেঙ্গল’ খেতাব অর্জন করেছিলাম আটের দশকের গোড়ায়। এছাড়াও ধাপে ধাপে বিভিন্ন হার্ডলস পেরিয়ে বিভিন্ন দিকপাল শিল্পীর সঙ্গে বাজিয়েছি। যেমন পন্ডিত যশরাজ জি, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, পন্ডিত বিরজু মহারাজ জি, উস্তাদ সাঈদ পারভেজ, উস্তাদ সুজান খান। একাধিকবার গ্র্যামি বিজেতা স্টিভ স্মিথ থেকে শুরু করে মামাদু দাবো, লিয়াম টিকের মতো ব্যাক্তিত্বদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি। ওয়ার্ল্ড-মিউজিকের ব্যান্ডও রয়েছে, যার নাম ‘উপাজ’। এছাড়া বিরজু মহারাজের জন্মদিনে বাজানো কিংবা উস্তাদ জাকির হুসেনের সান্নিধ্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পন্ডিত স্বপন চৌধুরী, পণ্ডিত কুমার বোস, অনিন্দ্য চ্যাটার্জী এনারা প্রত্যেকেই আমাকে স্নেহ করেন, আমার আমেরিকার স্কুলেওই এসেছেন।
এই মুহূর্তে ভারত সফরে কোথায় কাদের সঙ্গে বাজাচ্ছেন?
ইতিমধ্যেই মাইসোর এবং বেঙ্গালুরুতে অসাধারণ পরিবেশে সোলো পারফর্ম করেছি। কলকাতায় রিম্পা শিব এবং স্বপন শিবের সংস্থা ‘বন্দিশ’-এর অনুষ্ঠানেও বাজালাম। এছাড়াও খড়গপুর, হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠান করলাম। আগ্রার দয়ালবাগ বিশ্ববিদ্যালয় আমার নামে একটি সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে এবং আমার একটি সাক্ষাতকারও নিলেন তারা। সেখানেও পারফর্ম করলাম। আগামী ২৬ জানুয়ারী ব্যারাকপুরে সেতার-বাদক উস্তাদ সাঈদ পারভেজকে তবলায় সঙ্গত করবো। মোটামুটি ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ভারতে আমার অনুষ্ঠান রয়েছে।
এতদিনের পথচলায় কিছু ভালো মন্দ অভিজ্ঞতার কোথা আমাদের পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করুন।
ভালোর সংখ্যাই বেশি, মন্দ অভিজ্ঞতা খুবই কম। বড় নামদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বাজানোর সুযোগ পেয়েছি। গানবাজনা প্রত্যাশিত মানেও পৌঁছচ্ছে। মন্দই অভিজ্ঞতা বলতে নতুনদের মধ্যে কনসার্ট পাওয়ার লোলুপতা চোখে পড়ছে যা একেবারেই কাঙ্খিত নয়। আমাদের সময় কেউ ভালো পারফর্ম করলেই তার নতুন কনসার্টে বাজানোর ডাক আসতো। এই সময়ে সেই সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর শিল্পিরাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাজিয়ে চলেছেন। এরকম চলতে থাকলে প্রতিভাবান শিল্পীরা যাবেন কোথায়?
আগামী দিনে আপনার কোন কোন কাজ আমরা উপহার পেতে চলেছি?
এখন সেই অর্থে আমেরিকায় আমরা সিডি বের করিনা। উপাজের বেশ কিছু সিঙ্গলস ইতিমধ্যেই ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে। আমি, ইন্দ্রদীপ ঘোষ, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জী এবং ব্রজেশ্বর মুখার্জী ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক আনলিশড’এর কনসার্টে বাজিয়েছি, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিগনেচার ইভেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে। আগামীদিনেও সেটিকে রূপায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। ‘তা সে ধিন তক’ বলে শুধুমাত্র তবলারই একটি ইভেন্ট ২০২০-তে আমাদের স্কুলে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
অনেকের মতে ভারত এই মুহূর্তে এক ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে আমরা অন্ততঃ সাংস্কৃতিক ভাবে একজোট হতে পারছি না কেন?
সান্সক্রিতিকভাবে আমরা জোটবদ্ধ হতে পারছি না এটি বলবো না। কারণ আমরা জোটবদ্ধ হয়েই রয়েছি। আমাদের উস্তাদদেরও আমরা ভারতীয় হিসেবেই ভাবি, তারা ভীষণই মুক্তমনা। একটা কথা বলবো, আমি ভারতীয় হিসেবে জন্মেছি, ভারতীয় হিসেবেই মরবো। আমার ধারণা, এই যে বিভাজন সৃষ্ট করা হচ্ছে, তা আসলে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। আমাদের আরও বেশি করে নেতাজী, বিবেকানন্দ, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীনদের জানা উচিৎ।
বর্তমান রিয়্যালিটি শো ধ্রুপদী সঙ্গীতে কী প্রভাব ফেলছে?
ধ্রুপদী সঙ্গীতকে কোনওভাবেই টেলিভিশনে প্রোমোৎ করা হচ্ছে না। আধুনিক গানের যে রিয়্যালিটি শো গুলি হচ্ছে, সেখানে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের স্লট এতো কম যে মানুষ জানতেই পারছে না এই সঙ্গীত সম্পর্কে। এই রিয়্যালিটি শো গুলিতে গাইবার প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ নয়। যদিও শ্রেয়া ঘোষাল এই রিয়্যালিটি শোয়েরই ফসল। কারণ তার সঙ্গীতের ভিতটি শক্ত। ধ্রুপদী সঙ্গীতকে বাদ দিয়ে কেউই বড় জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। আর মনে রাখতে হবে, এই মার্গ সঙ্গীতই বিদেশের কাছে ভারতের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে তুলে ধরে।
তবলার নতুন শিক্ষার্থীদের কী পরামর্শ দেবেন?
একটি কথাই বলবো তাদের, যে মূল্যবান কথা আমাদের গুরুরাও আমাদের বলে গিয়েছেন। শিক্ষার সময় অমনোযোগী হওয়া ভালো না। এখনকার প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলছি, কনসার্ট অবশ্যই বাজানো উচিৎ। তাতে স্টেজ-ফ্রি হওয়া যায় অনেকটাই। কিন্তু যেন তেন প্রকারেণ মঞ্চে উঠতে হবে এর দরকার নেই।
আমরা সকলেই বলে থাকি সঙ্গীতের কোনও ধর্ম হয় না। তাহলে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উস্তাদ এবং পন্ডিত, এই বিভাজন কেন? আপনি কি এই বিভাজনকে সমর্থন করেন?
এটি মনে হচ্ছে মানুষ কোনও কারণে ভুল বুঝছে। উস্তাদ বলা হয় মুসলিম ধর্মের শিল্পীদের, হিন্দুদের আমরা পন্ডিত বলি। এখানে বিভাজন কোথায়? উস্তাদ ভীমসেন যোশীকে তো আমরা উস্তাদ বলতে পারবো না। এটি তো সংস্কৃতিরই ব্যাপার।
তবলাকে সঙ্গী করে এই দীর্ঘ পথচলায় আপনি বহু কিছু অর্জন করেছেন। আর কিছু কি পাওয়া বাকি রয়েছে?
জীবনে চাওয়া পাওয়ার কোনও শেষ থাকে না। আমি যেন বাজনা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আল্লা রাখা খাঁ সাহেবের কথাই বলবো। “ছাত্র হওয়ার চেষ্টা করো, শিক্ষক নয়।” সেরকম নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য নেই, তবলা যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বাজিয়ে যেতে পারি। তাই কতোটা পেলাম আর পেলাম না সেই হিসেব আমি করিও না।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS4 months agoমানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS9 months agoফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS9 months agoঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS10 months agoলকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!