কীভাবে তোমার শিল্পী হিসেবে পথ চলা শুরু?
সাঙ্গীতিক পরিবারেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। আমার ঠাকুর দাদা (ননীগোপাল চক্রবর্তী) সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। শুনেছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সামনে তারই গান গেয়েছিলেন। ঠাকুর দাদা দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার কখনও। তবে আমি যা দেখেছি তা হলো, অনেক দূর দূরান্ত থেকে বহু শিল্পী আমাদের বাড়িতে গান বাজনার আসর জমাতেন। রবীন্দ্র,নজরুল, টপ্পা, ঠুমরী, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ইত্যাদি চলতো। তখন আমি খুবই ছোট। সময়ের নিয়মে এখন সে মজলিস উঠে গেছে। স্কুল যাওয়ার বয়স যখনও হয়নি,তখন থেকেই গান শোনার ব্যপারটা ছিল সাংঘাতিক। সুতরাং গানের খুঁটিনাটি খুব ভালো ভাবেই গেঁথে যেত মনে।
পরবর্তীকালে আমার কাকা (ঈশ্বর) সমীর কুমার চক্রবর্তীর (সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন) সহযোগিতায় আমাকে তবলা শেখান মৃত্যুঞ্জয় পাল। মায়ের কাছে গানও শিখতাম।পরবর্তী কালে ২০০৬ সালে শ্রীরামপুরের অন্যতম শিল্পী আমার গুরুজী পন্ডিত শিবশঙ্কর কর্মকারের কাছে তবলার শিক্ষা শুরু হয়। পাশাপাশি গান নিয়েও অনেক স্বপ্ন দেখতাম। এখনকার বেশ কিছু গানের ওই তাৎক্ষণিক ভালো লাগা ব্যপারটা আমার পছন্দ ছিলো না। কথাগুলোও মনে ধরতো না। প্রচণ্ড একঘেয়েমি থাকতো এবং একই কথা সুর যেন ঘুরে ফিরে আসতো, বৈচিত্র্য ছিল না।
বড়রা বলতো স্বর্ণ যুগের গান শোনো, আজও সেগুলো কেমন ঝকঝকে হয়ে আছে। আর সত্যিই তাই। যদিও আমি আগাগোড়াই বাংলা গানের স্বর্ন যুগ, তাম্র যুগ ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নই। আমরাই স্বর্নযুগ ফিরিয়ে আনতে পারি। ইতিমধ্যেই পরিচয় ঘটেছে অনেক গুণীজনদের সাথে। সুরকার সৌমেন মুখার্জী এবং আমার জ্যঠামশাই তখন কয়েকটি অনুষ্ঠানের সুযোগও করে দিয়েছিলেন শ্রীরামপুরের বুকে। সৌমেন মুখার্জীর সুপারিশে ২০১৭ সালে নাগাদ শ্রীরামপুরের ক্লাসিক্যাল শিল্পী প্রমিথ গাঙ্গুলির সাথে আমার পরিচয় হয়। ওকে পেয়ে মনে হয়েছিল গান নিয়ে আমার স্বপ্নগুলোকে এবার হয়তো বাস্তব রূপ দিতে পারবো। ক্রমশ ওই আবিষ্কার করলো আমার ভিতরকার সমস্ত সম্ভাবনা।
আমার জীবনে প্রথম শর্ট ফিল্মের প্রস্তাব আসে ওরই হাত ধরে, যেটির নাম ছিল ‘বিশ্বাস’। নির্দেশক ছিল পৃত্থীজিৎ ঘোষ। স্কুল জীবনের নাটক করার অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগলো। এর পর প্রমিথের একটি শর্ট ফিল্ম ‘তিতির’-এ অভিনয় করি। সেখানেই আমার প্রথম দুটি গান মুক্তি পায়। একটি আমার কথা ও সুরের গান, অপরটি আমার কথা ও প্রমিথের সুরের গান। দুটোরই জনপ্রিয়তা ছিল সাংঘাতিক। সেইসঙ্গে সিনেমাটিও অনেকেই দেখেন। একটি টেলিভিশন চ্যানেলেও সিনেমাটি দেখানো হয়।
এর পর আমার লেখা গল্প ‘মূর্তিমান’ প্রমিথের নির্দেশনায় মুক্তি পায়। সবগুলিই আমাদের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ‘প্রমিথ গাঙ্গুলী’ থেকেই মুক্তি পায়। শিল্পী শুভায়ু ব্যানার্জীর গাওয়া আমার লেখা ও সুরের গান ‘কবিতার খাতা’ মুক্তি পায় এবং খুব ভালো সাড়া পাই। আমার লিরিক্সে ও প্রমিথের সুরে প্রমিথেরই গাওয়া গান ‘সুরভী’ গানটি অনেকের মুখে মুখে শুনেছি। যেটি শিল্পী হিসেবে পরম প্রাপ্তি। এছাড়াও সৌমেন মুখার্জীর প্রজেক্ট “তোকে দেখে” মিউজিক ভিডিওতে কাজ করেছি। এছাড়াও অনেক কাজ করেছি, আরও বহু কাজ বাকি।
তুমি কি মনে করো শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে প্রতিভাটাই যথেষ্ট?
অবশ্যই প্রতিভাটা বিরাট একটা জিনিস। কিন্তু যেটা খুব দরকার তা হলো বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা, অনুরাগ। এগুলো থাকলে শিল্পীর অনুশীলন ক্ষমতা বা রেওয়াজ অনেক বেড়ে যায়।
এখনও পর্যন্ত কী কী উল্লেখযোগ্য কাজ করেছো?
আমার সব কয়টি কাজই আমার কাছে খুব প্রিয়। তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে সবার আগে রয়েছে ‘তিতির’। যেখানে আমি আমার অনেকগুলো সত্ত্বাকে একসঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছি। এছাড়াও আমার লেখা ও সুরের একটি গান ‘রাজ ভিখারী’ গেয়েছেন প্রমিথ গাঙ্গুলি। এর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘কৃপন’ আবৃত্তি করেছেন পিয়ালী পাঠক।ওদের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পাশে নিজের লেখা গান বসানোটা সত্যি একটা বড়ো চ্যলেঞ্জ ছিল। কিন্তু মানুষ ভালো ভাবেই গ্রহন করেছেন।কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ১৫ হাজারের মতো মানুষ দেখেছেন। অনেক গুণী শিল্পী বিষয়টিকে পছন্দ করেছেন, আমাদের আশির্বাদও করেছেন। চেষ্টা করেছিলাম উপস্থাপনাটিও যাতে অভিনব শৈলীতে করা যায়। আসলে গানটি আমার নিজের জীবনের প্রতিফলন। সম্প্রতি প্রমিথের সঙ্গে একটি কীর্তন গেয়েছি, যেটি খুব ভালো সাড়া দিয়েছে। ভিন রাজ্য থেকে ইতিমধ্যেই কীর্তন, ভক্তিমূলক গান গাওয়ার ডাক এসেছে। এই বছর সুরকার হিসেবে গুগুল ভেরিফাই শিল্পী হয়েছি। সেটাও খুব আনন্দের।
তোমার কোন কোন কাজ মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে?
আগামী সরস্বতী পুজোয় আমার একটি অ্যালবাম হিসেবে রিলিজ করছে ‘কাফিলা’। সেখানে আমি লিরিসিস্টের ভূমিকায় থাকছি। কত তারিখ বেরোচ্ছে তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
তুমি যে কাজগুলো করো, সেক্ষেত্রে তোমার অনুপ্রেরণা কারা?
শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আমার জীবনে চলার পথে অনুপ্রেরণা। তারপরেই আগে মা বাবা, তারপর আমার সমস্ত শিক্ষা গুরু এবং আমার গোটা টিম। যাদের সঙ্গে আমি কাজ করি তারা আসলে একটি পরিবার আমার কাছে।
লিরিক্স লেখার সময় মূলতঃ কোন ভাবনা তোমার মগজে ধাক্কা মারে?
সবার আগে মাথায় আসে বর্তমান সমাজের কথা।আমার বিশ্বাস, ভালো লিরিক্স দিয়েও সমাজকে ভাবানো যায়।
সামাজিক ইস্যুর প্রতিফলন কি তোমার কাজে দেখা যায়?
আমার লেখা ও প্রমিথের নির্দেশনায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘মূর্তিমান’ খানিকটা সেরকমই বলতে পারেন। ন্যারেশনেও আমি ছিলাম এখানে। এমন একটি সময় মুক্তি পায় ছবিটি, যখন ভারত তথা বাংলার রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে এক বিচ্ছিরি রকমের ভাইরাস। তা হলো ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভাগাভাগি করার মনোভাব। ওই গল্পে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের কথা বলার চেষ্টা করেছি। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়, দুই মত। কিন্তু ধর্ম একটাই, তা হলো মানবতা। ধর্ম আচরণের বস্তু। ভগবান ভগবান বলে দেবমূর্তির চরণে পড়ে থাকাকে ধর্ম বলে না।
রিয়্যালিটি শো কি শিল্পী তৈরি করে, নাকি তারকা তৈরি করে?
এই প্রশ্নেই কিছুটা উত্তর লুকিয়ে রয়েছে। তারকা যে তৈরি করে একথা ঠিক। তবে পরে সব কেমন যেন হারিয়েও যায়। আবার শিল্পী তৈরী হয়েছে এমন নজিরও রেখেছে এই রিয়ালিটি শো । তবে ওই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্যে যদি দু’একটি ভুল জিনিসও পরিবেশন হয়, তখন ওই ভুলটাকেও ঠিক ভেবে আমরা ভুল করি।
তোমার সুরকার হিসেবে টার্নিং পয়েন্ট কী?
আমার প্রথম গানটি। ‘আজ তুমি আছো দূরে’ প্রমিথের বলিষ্ঠ গায়কীতে গানটি আশাতীত জনপ্রিয় হয়েছে। Bengali mp3 থেকে গানটি অনেক ভিউ হয়েছে।সেটাই আমার টার্নিং পয়েন্ট। গানটি কানাডার মাটিতে এক প্রবাসী বাঙালি একটি অনুষ্ঠানে গানটি মঞ্চস্থ করেন। এটি আমার কাছে প্রচণ্ড গর্বের।
তোমার মতে মানুষ এখন কী ধরণের বিষয়বস্তু পছন্দ করছে?
এগুলো কিছুটা মানুষ বিশেষেও নির্ভর করে। তবে ভালো মন্দের পার্থক্যটা কিন্তু সবাই বোঝে।
ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনদের জায়গা বর্তমানে কতোটা রয়েছে?
লড়াই করতে হয় খুব। বৈষম্যের শিকার তো হতে হয়ই। এমনও শোনা যায় যে অনেক ক্ষেত্রে নবীনরা প্রবীণদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তবে নবীনরা অনেক বেশি অ্যাডভান্স।
শিল্পী হিসেবে পথচলায় তোমার ভালো বা খারাপ অভিজ্ঞতা।
ভালো অভিজ্ঞতা তো আছেই, প্রায়শই ভালো অভিজ্ঞতা হয়। আবার খারাপও আছে। তবে সেকথা না বলে যারা খারাপ করতে চেয়েছে তাদের মনের অনুতাপ বাড়াতে চাই, আপাতত এটুকুই বলবো।
অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা কি সঙ্গীতের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা সত্যি খুব খারাপ। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, অরিজনাল ভয়েসের আলাদাই মেজাজ। এই পার্থক্যটা কিন্তু অত্যন্ত সাধারণ মানুষরাও বুঝতে পারেন।চর্চাহীনতার একটা ছাপ থাকবেই। প্রযুক্তি আসলে সবটা ঢাকতে পারেনা।
একজন শিল্পী হিসেবে সমাজের প্রতি কি দায়িত্ব রয়েছে?
শিল্প সর্বদাই সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে এসেছে। তাই আমার লক্ষ্য থাকবে সৎ ভাবের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, এমনতর শিল্প পরিবেশন করা।
স্বপ্ন কী?
স্বপ্ন হলো বাংলায় ভালো ভালো কনটেন্ট আনা। বাংলা সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসাবে বাংলা গানের, বাংলা শর্ট ফিল্মের ভূমিকা অবশ্যই আছে।সুতরাং, রুচিশীল গান, ফিল্ম,কন্টেন্ট আরও আরও বেশি সৃষ্টি করা।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS2020.10.20মানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS2020.06.09ফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS2020.05.25ঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS2020.04.19লকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!