এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়া, বাংলাদেশি পেরানোইয়ার রাজনৈতিক প্রয়োগ এবং অমর্ত্য সেন এর “বিভ্রম থেকে হিংসা” তত্ত্ব
অমর্ত্য সেন তাঁর বিখ্যাত “পরিচিতি ও হিংসা” গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছদে বিভ্রম থেকে হিংসা তত্ত্বের বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে ধর্ম বা সংস্কৃতি অনুযায়ী মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন বর্গে ভাগ করা যায়। এই ধারণাই সমকালীন জগতে সম্ভাব্য সংঘর্ষের এক প্রধান উৎস। (১) অসমের জাতীয়তাবাদি রাজনীতিতে এই ধারণার প্রত্যক্ষ প্রয়োগ লক্ষণীয়। নেলি থেকে শুরু করে বড়ো ল্যান্ড, বাঙাল-খেদা থেকে হালফিলের বিদেশ বিতাড়ন পর্যন্ত অসমে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে (নাকি ঘটানো হয়েছে ) সেগুলির মূলে যে খিলঞ্জিয়া বা মূল অাদিবাসী এবং বহিরাগত দ্বন্ধটি রয়েছে সেটির তথ্যমূলক বিশ্লেষন করলে এ সত্যটি খুব সহজেই নজরে পড়ে। এ নিবন্ধে এরই একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস করা হলো।
বিদেশি অনুপ্রবেশ সত্য না বিভ্রম– ইতিহাস এবং তথ্য কি বলছে
১৯৫১ থেকে শুরু করে ২০১১ পর্যন্ত জণগণনার হিসেবে দেখা যায় ১৯৫১ সালে সর্বভারতীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ২১.৬৫%। সেখানে শরণার্থীদের নিয়ে হয় ৩৪.৯৮% । সেটা ১৯৭১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বেড়ে যথাক্রমে ৫৪.৪১% এবং ৫৩.২৬% গিয়ে দাঁড়ায়। আবার ১৯৯১ ও ২০০১ সালে ২১.৫৪% এবং ১৮.৯২% এ নেমে আসে। ২০১১ সালে আরো কমে হয় ১৭.৬৪% এবং ১৬.৯৩%। সুতরাং একথা খুব সহজেই অনুমেয় যে ১৯৫১ এবং ১৯৭১ এর স্বীকৃত প্রবজন ছাড়া ১৯৭১ এর পর থেকে সংখ্যাতত্ত্ব মতে জনসংখ্যার কোনো অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি ঘটেনি। (২)
এবার ১৯০১ সালের জণগণনায় পাওয়া তথ্য মতে অসমের মোট ৩৩ লাখ মানুষকে যদি অসমের আদি বাসিন্দা হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সর্বভারতীয় বৃদ্ধির হার মতে ১৯৪১ সালে অসমের জনসংখ্যা হওয়া উচিত ৫৭ লক্ষ। অথচ জণগণনার পরিসংখ্যান মতে অসমের জনসংখ্যা ৬৭ লাখ। মানে প্রায় ৯ লক্ষ মানুষ তখনই অসমে প্রবজন করেছিলেন। সেইসঙ্গে মুসলিমদের মোট সংখ্যা হওয়া উচিত ৮.৮ লক্ষ। অথচ দেখা যাচ্ছে তখন অসমে মুসলিমরা ছিলেন মোট ১৬.৯ লক্ষ এবং বলাই বাহুল্য এদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মুসলিম ভূমিহীন চাষি। সেই অনুপাতে বর্তমানে অসমের জনসংখ্যা যদি হয় ৩,১২,০৫,৫৭৬ জন তাহলে মুসলিমদের ভৌগলিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বাধা-নিষেধের কথা মাথায় রাখলে এটা কি খুব একটা অস্বাভাবিক শোনায়? নিশ্চয়ই নয়। তাছাড়া জণগণনা পরিসংখ্যানগুলিতে আরো একটি কথা স্পষ্টভাবেই উঠে আসছে। সেটি হল অসমে ১৯৭১-এর পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমছে। ১৯৯১ এ যা ছিলো ২৩.৫৮%, ২০০১-এ হয় ১৮.৯৮% এবং ২০১১ তে তা আরও কমে ১৭.০৭% তে গিয়ে দাঁড়ায়।তাহলে কোথায় সেই লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি যারা অসমের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাড়াচ্ছে? পরিসংখ্যান এর বিপরীতে গিয়ে যুক্তিহীনভাবে মিথ্যে ভয়ের শিকার হওয়াটা নিছক পেরানোইয়া ছাড়া আর কী? এভাবে ভিত্তিহীনভাবে একটি ভাষিক গোষ্ঠীকে একই ভাষিক সম্প্রদায়ের অন্য একটি গোষ্ঠীর (৩) বিরুদ্ধে মিথ্যে উসকানি দেওয়াটা নিশ্চিতভাবে বিভ্রম সৃষ্টিকারি কাজ। আর এর ফলে যে হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তার জীবন্ত সাক্ষী হলেন নেলি-গহপুর সহ কোকরাঝাড়ের দাঙ্গার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা হাজার হাজার মানুষ। এই নিছক পেরানোইয়াটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে ডি-ভোটার নামক তকমা গায়ে এঁটে এক প্রবল অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতায় মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। প্রত্যেক বার জনগণনার শেষে পরিসংখ্যানগুলির আংশিক উদ্ধৃতি দিয়ে অসমের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা ফলাওভাবে ছাপানোর পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে একই উদ্দেশ্য।
এনআরসি কি এই বিভ্রমের কোনও যুক্তিপূর্ণ সমাধান?
উত্তর হচ্ছে একেবারেই নয়। বরং সমস্যাটিকে আরো জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।কারণ, প্রথমতঃ বিদেশিদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কোনও ধরণের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই। সুতরাং বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত লোকদের আইনীভাবে কখনো বাংলাদেশের কাছে পত্যার্পণ করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়তঃ কাউকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার পর তাদের নিজের দেশে ফেরত না পাঠিয়ে জেলে পুরে রাখা অান্তঃরাষ্ট্রীয় আইনের সম্পূর্ন বিরোধী। তৃতীয়তঃ কিছু লোককে বিদেশি চিহ্নিত করে তাদের ফেরত না পাঠানো অথচ নিজের দেশের নাগরিকের মর্যাদা না দেওয়াটাও রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ১৫(৩) মতে সরাসরিভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বোঝায়। তাছাড়া অতি সম্প্রতি বিষয়টিকে আরও জটিল করতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ত্ব প্রদানের জন্য যে বিল পাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ন প্রক্রিয়াটিকে আরো ধোয়াশাপূর্ণ করে তুলছে। সেইসঙ্গে এটি দেশের সংবিধান এর ১৪, ২১ এবং ২৩ নং ধারারও বিরুদ্ধে যাচ্ছে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বিনষ্ট হতে পারে। এই অবস্থায় লাখ টাকার প্রশ্নটি হল সরকারপক্ষ (তা সে যে কোনও দলেরই হোক) সমস্ত জটিলতার বিষয়ে অবগত নন। নাকি ইচ্ছে করেই অসমের জণগণকে এই জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিলে বোধহয় অনেক প্রশ্নেরই সমাধান হয়ে যাবে।
শেষকথা
শরণার্থী, বাংলাদেশি কিংবা তথাকথিত ওয়াই আর ও ওয়াই ক্যাটাগরি যে নামেই সম্মধন করা হোক না কেন মানুষের কিংবা আরো স্পষ্টভাবে বললে নাগরিকদের মধ্যে দুটি শ্রেণি সৃষ্টি করলে যে নিট ফলাফল আসে তার একটি হল সস্তায় শ্রম। চা-বাগানের লোকেরা যেটা শতাব্দী ধরে দিয়ে আসছে(তাই কি ওরা এন আর সি বিভ্রমে সহজে রেহাই পেলেন)।তার সাথে যদি বাঙালি, নিম্নশ্রেণির হিন্দু এবং মুসলিমরাও যুক্ত হন তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত এবং ব্যবসায়িক শ্রেণি তো লাভবান হচ্ছেনই সেই সঙ্গে ফাউ হিসেবে রাজনীতিতেও যুক্ত হচ্ছে এক নতুনমাত্রা। যেকোনও সময়ে এই বিভ্রমকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক লাভালাভির হিসেব কষা যাবে। সেই নিটফল মাথায় রেখেই কি তৈরি হচ্ছে ডি-ভোটারদের “শিন্ডলার্স লিষ্ট”?!
জানি যোগ-বিয়োগের এই অঙ্কগুলো একটু কঠিন হয়ে গেলো কিন্তু এ জটিল বিষয়কে এর চেয়ে সহজভাবে আর দেখা গেল না।আর অযথা সরলীকরণ বোধহয় বিভ্রম সৃষ্টিতে পরোক্ষভাবে সাহায্যই করে।
১। পৃষ্ঠা – ১৩, পরিচিতি ও হিংসা, অমর্ত্য সেন, অনুবাদ-ভাস্বতী চক্রবর্তী, ২য় মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১১।
২। Census of india.co.in
৩। আমার জানা মতো অসমিয়া এবং বাংলা দুটিই ইন্দো-আরিয়ান ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।