হুগলীর শ্রীরামপুর একটি ঐতিহাসিক শহর এ কথা প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু এই শহরের পত্তনের আগে থেকেই ৫০০ বছরের এক শিব মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে এটা বোধহয় অনেকেই জানেন না। শ্রীরামপুরের একেবারেই প্রান্তসীমায় বাঙ্গিহাটীতে দিল্লি রোডের খানিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির। তাই সেই ইতিহাসের সন্ধানে চলে যেতেই হল বাঙ্গিহাটির উদ্দেশ্যে। শ্রীরামপুর স্টেশনের পশ্চিম পাড়ের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে অটোতে ২০ মিনিটের রাস্তা। অকুস্থলে পৌঁছে দেখা গেল কীভাবে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে বারোটি শিব মন্দির। এই মন্দিরকে সন্তান স্নেহে এখনও আঁকড়ে রেখেছেন দীননাথ চক্রবর্তীর বংশধররা। তাদেরই এক কনিষ্ঠ প্রতিনিধি সুতীর্থ ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন কয়েক শতক পিছনে।
আনুমানিক পাঁচশো (মতান্তরে তিনশো) বছর আগের কথা। কোনও এক নিঃসন্তান রাজামশাই (রুদ্রপ্রসাদ চৌধুরী) হঠাৎ কাশী-বিশ্বনাথ দর্শন করার মনস্থির করলেন। সেই উদ্দেশ্যেই গঙ্গাবক্ষে নৌকাতে শুরু হয় যাত্রা। নৌকা যখন বর্তমান শেওড়াফুলি ঘাটের কাছে মাঝরাতে এসে উপস্থিত হয়, তখনই ঘুমের মধ্যে রাজামশাই মহাদেবের স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হন। স্বপ্নে নির্দেশ আসে বাঙ্গিহাটী নামক স্থানে বারো মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সেবাইত পদে নিযুক্ত থাকবেন আঁড়িয়াদহ নিবাসী ব্রাহ্মণ শ্রী দীননাথ চট্টোপাধ্যায়। এলাকায় সৎ ব্রাহ্মণ হিসেবে দীননাথ চট্টোপাধ্যায়ের যথেষ্টই সুনাম ছিল। পরদিন ভোরেই আর দেরি না করে রাজামশাই নৌকা নিয়ে বাঙ্গিহাটী চলে আসলেন। বাঙ্গিহাটী তখন ছিলো দুর্ভেদ্য অরণ্য এবং দস্যুদের ঘাঁটি। স্থলপথে সেই রাস্তা অতিক্রম করে রাজামশাই চললেন তাঁর গন্তব্যের দিকে। হঠাৎ এক জায়গায় তাঁর গাড়ির চাকা মাটিতে বসে যায়। সবাই মিলে বহু চেষ্টা করেও তা তুলতে পারলেন না। কাজেই এটিকে দৈব নির্দেশ মনে করে সেখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন রাজা।
সুতীর্থ আরও জানান, শিবলিঙ্গগুলি রাজস্থানের জয়পুর থেকে গরুর গাড়িতে আনানো হয়েছিল। মন্দিরের ইটগুলিকে বিশেষ পদ্ধতিতে ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় এবং বড় থেকে ছোট করে কলসীর আকার দেওয়া হয়েছে। শামুকের খোল পুড়িয়ে চুন এবং খারাপ হয়ে যাওয়া ইট গুঁড়িয়ে সুরকি বানানো হয়েছিল। মন্দিরের প্রতিটি দরজা সেগুন কাঠের তৈরি। এই ভাবে প্রতিষ্ঠা হলো মন্দির এবং স্বপ্নাদেশ মতো সেবাইত হিসেবে আনা হলো দীননাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কেই। দীননাথ বাবুর প্রতি মুগ্ধ রাজামশাই তাঁকে দক্ষিনা স্বরূপ শতাধিক জমি এবং ‘চক্রবর্তী’ উপাধি দিলেন। পরবর্তীকালে দীননাথ বাবুর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে এবং মন্দিরকে কেন্দ্র করে এলাকাটি জনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে মন্দিরের তৎকালীন সেবাইত তথা রাজ্যধরপুর এলাকার প্রধান ডাঃ কালিদাস চক্রবর্তী বেশ কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরকে পুনঃসংস্কার করেন। মন্দির সংলগ্ন দক্ষিণা কালি মন্দির এবং রাধা গোবিন্দ জিউর মন্দিরও সেই বছরই কালিদাসবাবু প্রতিষ্ঠা করেন। এরও একটি কাহিনী আছে। একদিন কালিদাস বাবু স্বপ্নে দেখেন, একটি ছোট্ট শ্যামবর্ণা, এলোকেশী এবং লালপাড়ের শাড়ি পরিহিতা মেয়ে তাঁকে এই প্রাচীন শিব মন্দিরেই আনন্দময়ী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিচ্ছেন।
সেই বছরই (১৩৮৫ বঙ্গাব্দে) শকুন্তলা কালিপূজার দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা এবং আরাধনা শুরু হয়। ঠিক পাশেই অবস্থিত রাধা গোবিন্দ মন্দিরটিও দোল পুর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠিত হয়। দীননাথ বাবুর বংশধরের মধ্যেই আরেক জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি হলেন সুব্রত চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, আজও দীননাথ বাবুর বংশধরেরা রক্ষা করে চলেছেন এই পারিবারিক ঐতিহ্য। তাঁর আবেদন পাঁচ শতকের এই ইতিহাসের দলিল অবশ্যই হেরিটেজ সাইটের তকমা দাবি করে।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS2020.10.20মানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS2020.06.09ফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS2020.05.25ঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS2020.04.19লকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!