সঞ্জীব সরকার। অভিনয় জগতে পরিচিত মুখের মধ্যে তিনি অনন্য। নিজের স্বতন্ত্র্য পরিচয় যেমন নির্মাণ করতে পেরেছেন, ঠিক তেমনি মাটিতে পা রেখে সকল সমালোচনাকে স্বাগত জানাতেও দ্বিধা বোধ করেন নি। দীর্ঘ তিন দশকের অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে আজ ‘এক্সক্লুসিভ অধিরথ’-এর ওয়েব-পর্দায় এলেন তিনি।
নাটক, মেগা-সিরিয়াল এবং সিনেমা, আপনি এই তিন মাধ্যমেই কাজ করেছেন। নিজেকে সব থেকে বেশি খুঁজে পান কোন মাধ্যমে?
এক কথায় বলতে গেলে তিনটি মাধ্যমেই নিজেকে আমার মতো করে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। আমি মনে করি তফাৎ একটিমাত্র জায়গায়। আর সেটি হল একটু প্রয়োগ-বিধির তফাৎ। ধরা যাক, আমি অ্যাকাডেমীর মঞ্চে অভিনয় করছি, তখন আমার গলাটা একটি স্কেলে বাঁধা থাকবে। আবার আমি যদি এমন কোনও মঞ্চে অভিনয় করি যেখানে মাইক্রোফোন আছে, সেখানে একজন অভিনেতা হিসেবে আমাকে মাইক্রোফোনের ব্যাবহারটিও জেনে নিতে হবে। ফলে সেখানে মাইক্রোফোনের প্রয়োগ-কৌশল মাথায় রেখে অভিনয় করতে হয়। যখন মেগা-সিরিয়ালের ক্ষেত্রে অভিনয় করি, তখন সেটা ঠিক অভিনয় নয়। একটু সহজ, স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার ধরণ, যাতে মূলতঃ ঘরের দর্শকরা বুঝতে পারেন। সেটার মাধ্যমেও নিজের অভিনয় সত্ত্বাটাকে খুঁজে পাই। আবার বড় পর্দার ক্ষেত্রে, সেটি যেহেতু ক্যানভাসে হয়, তাই তখন সেই ছোট পর্দাটাকেই একটু বড় করে তোলার চেষ্টা থাকে। কিন্তু কোনও একটি চরিত্র নির্মাণ করতে গেলে, তাঁর যে খুঁটিনাটি ভাবনা-চিন্তাও মাথায় রাখতে হবে। আমি তো অভিনয়ের সেই চরিত্রটি নয়। আমি একটি ভিন্ন মানুষ। অভিনয়ের প্রয়োজনে আমাকে সেই চরিত্রটি হয়ে উঠতে হয়। একজন পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে আমাকে তাঁর সমস্তটা জানতে এবং বুঝতে হয়। সেটি মঞ্চেও যেরকম হয়, ছোট পর্দা, বড় পর্দা, আকাশবাণীতেও ঠিক সেরকমই হয়।
অভিনয়ের সঙ্গে আপনার রিলেশনশিপ শুরু কী করে হল?
এটা খানিকটা ওই ছেলেবেলায় প্রেমে পড়ার মতো। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। খুব ছোটবেলায় আমরা দারিয়া বাঁধা, কবাডি, চোর-পুলিশ এসব খেলতাম। এর মধ্যে চোর-পুলিশ খেলাটা খেলতে আমি বিশাল আগ্রহ পেতাম। ছোটবেলা থেকেই কেন জানিনা, যে কোনও বিষয়ে সংলাপ মুখে বলতে আমার বেশ ইচ্ছে করতো। আমার মনে পড়ে, আমাদের বাড়ির ছাদে চাণক্যের সংলাপ মুখস্থ করে একা একা আকাশের দিকে মুখ করে বলতাম। এইটাই একদিন মঞ্চে এসে পড়লো। স্কুলে সরস্বতী পূজো উপলক্ষ্যে একটি নাটকে সুযোগ পেলাম। তারপর ওই যে মঞ্চে উঠে নাটকটি করলাম, দর্শকদের প্রশংসাও পেলাম। সেই থেকেই অভিনয়ের প্রেমে পড়লাম। সেই প্রেমে ইন্ধন জোগালো বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল।
এই সময়ে একজন অভিনেতা/অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে প্রতিভাটাই কি যথেষ্ট?
প্রতিভা তো যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই জরুরী। যদি অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি, তাহলে একজন অভিনেতাকে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করার ক্ষমতা, তাঁর একটু মিউজিক্যাল সেন্স এগুলি তো তাকে জানতেই হয়। আরও অনেকগুলি বিষয় রয়েছে যেগুলির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তাকে অনুশীলন করতে হয়। অনুশীলনের মাধ্যমে ঘষা-মাজাটাও অত্যন্ত জরুরী। তাই আমার মনে হয় শুধু প্রতিভাকে সম্বল করে কেউ এগোলেই আমি মনে করি না সে সাফল্যের দিকে এগোতে পারে। প্রতিভা তো সাফল্যের এক অন্যতম চাবিকাঠি, কিন্তু প্রতিভাটিকে ধরে রাখাও একটি বিষয়। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত, আমার জন্য কতোটা বরাদ্দ আছে। আমার বিশ্বাস, আমার জন্য যেটুকু বরাদ্দ রয়েছে সেটি আমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না যদি আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকে।
টেকনিক্যালি অভিনয় করে বেরিয়ে যাওয়া, নাকি চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করে চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করা, কোনটি একজন অভিনেতা/অভিনেত্রীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ?
আমি তো দ্বিতীয়টির ওপর বেশি জোর দিই, তবে প্রথমটিকে একেবারে অবহেলা করি না। তাঁর কারণ টেকনিক্যাল ব্যাপার তো থেকেই যায়। আমি অভিনয়ের একটা সত্ত্বা যার অন্বেষণে ঘুরছি, ফিরছি। অবশেষে তাকে পেলামও। কিন্তু পেলাম মানেই তো তার শৈল্পিক প্রদর্শন ঘটিয়ে দিতে পারবো তা তো নয়। আমাকে তার টেকনিক্যাল দিকটিও ভাবতে হয়। অর্থাৎ আমি মঞ্চে কোন জায়গায় কতটুকু অ্যাঙ্গেল ঘেঁষে দাঁড়ালে আমি ঠিক আলোটা নিতে পারবো। তবে এগুলিতে মাথা রেখেও আমি বলবো প্রাথমিক দিকটি হল চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা। তাই অভিনয়ের ক্ষেত্রে এই দুটিরই মিশেল থাকাটা আবশ্যক।
নওয়াল আগাড়িয়া, হন্তারক, বখতিয়ার খিলজির পরে আপনাকে ফের কোন নতুন চরিত্রে থিয়েটার-প্রেমীরা দেখতে পাবেন?
সম্প্রতি আরও দুটি নাটক নেমে গিয়েছে। একটি ‘মুদ্রারাক্ষস’ যাতে অমাত্য রাক্ষসের চরিত্রে আমি অভিনয় করছি। চাণক্যের চরিত্রে রয়েছেন আপনাদের সকলের পরিচিত গৌতম হালদার। যারা এখনও দেখেন নি, দেখে নেবেন। অপরটি ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। এটিরও শো চলছে। যেহেতু নতুন একটি নাটক এখনও ভাবনাচিন্তার পর্যায়ে রয়েছে তাই এক্ষুণি সেটির নাম বলছি না।
‘হন্তারক’ এবং ‘শেকল-ছেঁড়া হাতের খোঁজে’ নাটকে আপনার চরিত্র রাষ্ট্রীয় শোষণ, রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতার অপব্যাবহারের বিরোধিতার কথা বলে। সেখানে ‘চতুষ্পাপ’ নাটকে বখতিয়ার খিলজি রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে একটি চরিত্র। এই রূপান্তর কতোটা কঠিন?
কঠিন তো বটেই, তবে একজন অভিনেতাকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে জানতে হয়। ‘হন্তারক’ এবং ‘শেকল-ছেঁড়া হাতের খোঁজে’ নাটকে যে দুটি চরিত্রে আমি অভিনয় করি, সেগুলি যদিও ভিন্ন মেরুর চরিত্র। নওয়াল আগাড়িয়া শ্রমিক, কৃষক, মজদুর এই সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা একটি চরিত্র। কিন্তু হন্তারকে আমি যে চরিত্রে অভিনয় করি সে একজন প্রোফেসর। সে সমাজের বেশ কিছু অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না দেখে সে নিজেই আইন হাতে তুলে নেয়। অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে হত্যা শুরু করে। কিন্তু সেই অস্ত্রের মালিকানা তার মধ্যে যখন গেঁথে বসে সে বুঝতে পারে, তার মধ্যে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক প্রবণতা জন্মাচ্ছে। সেই সময় সে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ফলে এই দুটি চরিত্র ভিন্ন হলেও বক্তব্যের দিক দিয়ে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। উল্টোদিকে চতুষ্পাপে বখতিয়ার খিলজি যিনি লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলায় তুর্কি আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কীভাবে তিনি রক্তপাত ঘটিয়ে হত্যালীলা চালিয়ে তছনছ করেছিলেন বাংলাকে সেটি চরিত্রে ফুটিয়ে তোলাটা সত্যিই ‘চ্যালেঞ্জিং ক্যারেক্টার’ হয়ে উঠেছিল। তবে আমি এই চ্যালেঞ্জকে খুব সহজভাবে নিয়েছি এবং উপভোগ করেছি।
দীর্ঘ তিন দশকের পথচলায় কোনও ভালো বা খারাপ অভিজ্ঞতা।
এরকম নানান অভিজ্ঞতাই প্রতিদিন আমাদের হয়। আসলে আমাদের তো প্রতিদিনই পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয় নিজেকে। আজকে আমি একটা ভালো শট দিলাম, এটা আজকের জন্যই যথেষ্ট। কাল কিন্তু আবার আরেকটা অন্য লড়াই। কাল যদি আমি ক্যামেরার সামনে গিয়ে ধ্যাড়াই তাহলে কিন্তু কালকেরটাই কাল প্রতিষ্ঠিত হবে। কাল কিন্তু কেউ বলবেন না, উনি অমুক তারিখে দারুণ সংলাপ বলেছিলেন। সেই বিচারে আমার সেদিন কিন্তু কোনও মাফ নেই। কাজেই প্রতিদিন আমাদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হয় এবং তাতে অভিজ্ঞতাও থাকে। তবে এই অভিজ্ঞতাকে খুব বেশি মূল্য দিতে শুরু করি, তাহলে সেটি কিন্তু লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। আমাকে নিয়ে ধরা যাক, খুব প্রশংসা হচ্ছে। আমি তাতে আহ্লাদে বিগলিত হয়ে অনুশীলন কমিয়ে দিলাম, স্টার হয়ে গেছি ধরণের মনোভাব পুষতে শুরু করলাম। তাতে আখেরে ক্ষতি তো আমারই। আবার উল্টোদিকে নেগেটিভ সমালোচনা শুনে এড়িয়ে যেতে লাগলাম। সেটাও ঠিক না। তবে ভালো বা মন্দ যাই বলুন, একটা জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে যে তিনি আমাকে নিয়ে ভেবেছেন।
আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন। এই লম্বা সফরে এমন কোনও মুহূর্ত এসেছে যখন ভয়ানক ডিপ্রেসনে মনে হয়েছে যে, আর কাজই করবো না। যদি হয়ে থাকে, তবে সেটি কাটিয়ে উঠলেন কীভাবে?
এদিক থেকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়, সেরকম কোনও পরিস্থিতিতে আমাকে পড়তে হয়নি। আপনারাও আমাকে সেই শুভেচ্ছাই দিন যাতে এই পরিস্থিতিতে কোনোদিন পড়তে না হয়।
আগামী কোন কোন সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে?
‘হইচই আনলিমিটেড’ সিনেমাটি মুক্তি পাচ্ছে সামনেই। তাতে দেবও অভিনয় করেছেন। আমাদের থিয়েটারের অনেকেই রয়েছেন। খরাজদা আছেন, অর্ণ মুখোপাধ্যায় আছেন, শাশ্বতদা আছেন, আমিও রয়েছি।
মালদা GKCIET-এর ছাত্রছাত্রীরা ৬ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশুনা করে প্রতারণার শিকার। তাদের সার্টিফিকেটটিই জাল এবং তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। আজ দু’মাস ধরে তারা তাদের ন্যায্য দাবিতে লড়াই চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলছেন?
একজন শিল্পকর্মী এবং মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত বোধ করছি। আমাদের মা-বাবাও তো আমাদের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে চান। আমরা প্রত্যেকেই একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ পৃথিবী দিয়ে যাবো এই স্বপ্ন তো আমরা দেখি। সেই জায়গা থেকে কেউ যদি প্রতারিত হন তাহলে সেটি মানবতার লজ্জা। যেহেতু সরকার এই ভুলটি করেছেন, তাই তাদেরকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। আমি সবার হয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। খুব শীঘ্রই এর একটি মীমাংসা করার দাবি রাখছি।
অভিনয় ঘিরে আপনার স্বপ্ন কী?
ছোট থেকেই অভিনেতা হওয়ার একটা বাসনা কাজ করেছিল। তো সেখানে সেই অর্থে থিয়েটারের অভিনেতা অভিনেত্রীদের তো কাছে পেতাম না। বছরে একবার করে থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হতো যেখানে কলকাতার থিয়েটার দলগুলি যেত। সেটি দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। আর মাঝে মধ্যে হলে ভালো সিনেমা এলে দেখতে যেতাম। ফলে ওই থিয়েটার বা সিনেমার যারা পরিচিত মুখ তাদের মতোই হতে চাইতাম। কিন্তু আজ এই সময় এসে দাঁড়িয়ে সেরকম নামী কেউ হয়ে ওঠার অভিপ্রায় একেবারেই নেই। আমার মনে হয়, আমি যে কাজটি করছি, তার মূল্যায়ণ সমাজে কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে? সেটা কি শুধুই পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে হলে ঢুকে দু’ঘণ্টার বিনোদন হয়ে থাকবে? নাকি আমার সিনেমাটি বা নাটকটি এমন কোনও ইঙ্গিত বহন করবে, যা একটা মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। আমি কতোটা নামী হয়ে উঠলাম কিংবা আমার নামগন্ধ প্রায় কিছুই রইলো না সে নিয়েই মোটেই ভাবিত নই। আমি আমার থিয়েটার নিয়ে চলে যেতে চাই কোচবিহারের কোনও কৃষকের উঠোনে। আমি কোথায় করবো থিয়েটার? একটা শপিং মলে হতে পারে? সেটা একটা থিয়েটারের অঙ্গন হয়ে উঠতে পারেনা? আমি এখন স্পেস খুঁজছি। অদূর ভবিষ্যতে আমি ছবি নির্মাণ করতে চাই, কী হবে তার বিষয়বস্তু? এভাবেই ভাবনাকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে চাই।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS2020.10.20মানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS2020.06.09ফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS2020.05.25ঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS2020.04.19লকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!