“তুমি অন্ধকারের উৎসে করো আলোর সঞ্চার, জীবন-মৃত্যু এক করে দাও যৌবন ছারখার”। এই ধরণের বলিষ্ঠ ভাবনার অধিকারিণী যিনি হতে পারেন তার নাম পিয়ালী পাঠক। কলকাতা দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর পরিচিত মুখ ও কণ্ঠকে আজ আপনাদের সামনে হাজির করলো ”এক্সক্লুসিভ অধিরথ মিডিয়া’।
কী ভাবে আপনি একজন বাচিক শিল্পী হয়ে উঠলেন?
সাংস্কৃতিক জগতে আমার পদার্পণ মূলতঃ নৃত্যশিক্ষার মাধ্যমেই। আমার মা কলকাতার জহর শিশু ভবনে গান ও নৃত্যের তালিম পেয়েছেন। কার্যত তার প্রেরণাতেই আমার নৃত্যভাবনা শুরু। প্রথমে শ্রীরামপুর শহরের শঙ্কর কলামন্দিরে, পরবর্তীতে গুরু তনুশ্রী শঙ্করের কাছে তালিমের সুযোগ লাভ করি। তবে একটা সময়ের পরে আমার উচ্চশিক্ষার কারণে সেই তালিম বন্ধ রাখতে হয়। মেয়েবেলা থেকেই কবিতা, সাহিত্য, মূলতঃ রবীন্দ্রপ্রেম আমার মধ্যে ভরপুর। সেই প্রেমের টানেই ভাব-অনুভবে আওড়াতে লাগলাম কবিতা। ষাটের দশকে আমার বাবা বিদ্রোহের কবিতা বলায় এবং লেখায় বেশ উদ্যোগী ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় শুরু হল কবিতা পাঠ। এরপর একের পর এক প্রতিযোগিতায় বিচারকদের শুভেচ্ছা; পুরস্কার পাওয়া, না পাওয়া, সব মিলিয়ে কবিতা আবৃত্তিতে আবেগ মিশিয়ে তা শ্রোতাদের মনের মণিকোঠায় পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হলাম। সেই যাত্রাপথে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ার সহযোগিতা পেয়েছি।
আকাশবাণী কলকাতার যুববাণী বিভাগে সাময়িক ঘোষিকা হিসেবে প্রায় ৭-৮ মাস অনুষ্ঠান করার সুবাদে আলাপ হয় উর্ম্মিমালা বসু এবং জগন্নাথ বসুর সঙ্গেও। তাদের আশীর্বাদ লাভ করি। পরবর্তীকালে শ্রোতারাও আমার বাচনি পছন্দ করতে শুরু করেন। তাদের ভালোবাসা, প্রশ্রয় পেয়েই আজ আমি বাচিক শিল্পী।
কেন মনে হল আবৃত্তি দিয়েই আপনার বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন?
আবৃত্তি আসলে একটি শিল্প অথবা বলা যায় এটি একটি মাধ্যম। এই মাধ্যম কবি ও কবিতা পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে পাঠককে শ্রোতায় রূপান্তরিত করেন।
আমার মনে হয়েছে বিভিন্ন কবির জানা-অজানা অনেক কবিতাই বার্তা দেয় সমাজকে। আবার সেই কবিতাই অনেক সময় পরিবেশনের ঘাটতিতে সময়োপযোগী হয়ে ওঠে না। তাই বাচিক শিল্প বা মূলতঃ আবৃত্তির মাধ্যমেই সে কথা জানানো সম্ভব। যেমন কথাবিহীন সঙ্গীত সম্ভব নয়, তেমনই সুরবিহীন কথা দিয়েই আমরা বাচিক শিল্পী হিসেবে বার্তা পৌঁছে দিই সমাজের কাছে।
আপনি নিজে কবিতা লেখেন? সেই কবিতা কী মঞ্চস্থ করেন?
না, কারণ আমি কবি হতে আসিনি।
বাচিক শিল্পী হিসেবে কী কী উল্লেখযোগ্য কাজ এখনও করেছন?
এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু করে উঠিনি বলেই আমি অন্ততঃ মনে করি। তবে আমার কাছে আজ পর্যন্ত করা প্রতিটি মঞ্চ, প্রতিটি অ্যালবাম, প্রতিটি অডিও-ভিস্যুয়াল সবই উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই আবৃত্তিকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় না, এটা কেন? এ ব্যাপারে আপনার অভিমতই বা কী?
‘গুরুত্ব’ শব্দটির গুরুভার নিতে পারলাম না। কে বা কারা এমনটি ভাবেন আমার জানা নেই। তবে কেউ যদি এমনটি মনে করে থাকেনও তাহলে বুঝতে হবে একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে কোথাও। শিল্পী হিসেবে আমাদের কিংবা শ্রোতা হিসেবে তাদেরকেই দায়িত্ব নিয়ে এই ফাঁক পূরণ করতে হবে।
আবৃত্তির জন্য নিশ্চয়ই আপনাকে আইসক্রিমের মতো লোভনীয় খাবার খাওয়া ছাড়তে হয়েছে। এটা কী খারাপ অনুভূতি?
শুধু আইসক্রিমই নয়, যে কোনও ঠাণ্ডা পানীয়ই আমি খাই। তাতে আমার মন এবং গলা ঠাণ্ডা থাকে।
আপনি গ্রাম এবং শহর দুই জায়গাতেই অনুষ্ঠানে যান। চোখে পড়ার মতো কোনও ফারাক লক্ষ্য করেন?
ফারাক একটিই। গ্রামের দিকে আবৃত্তি শিল্প ঢিংচ্যাক সংস্কৃতি নয় বলে গ্রহণযোগ্যতার অভাব চোখে পড়ে। আবার কিছু জায়গায় বেশ প্রশংসাও পেয়েছি।
আপনার আগামী কোন কোন কাজ মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে?
আগামী ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবোধক কাজ তো রয়েইছে। এছাড়াও দুই কবির দুই বন্ধুর স্মৃতিচারণা নিয়ে আসছি আগামী পুজোর আগেই।
এই সময়ে আমার আপনার দেশ এক ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে অন্ততঃ সাংস্কৃতিকভাবে হলেও মানুষ যৌথবদ্ধ হয়ে উঠতে পারছেন না কেন?
একেবারেই, আমরা যে চরমতম ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে চলেছি তা বলাই বাহুল্য। রাউলাট আইনের (১৯১৯) একশো বছরের মাথায় আজও শুধুমাত্র সন্দেহের বিচারে একজনকে দেশদ্রোহী বলা যায়। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা শিল্পীরা যৌথ বার্তা রাখতে পারছি না। তার প্রধানতম কারণ শুধুমাত্র শিল্পচর্চা আর খ্যাতির প্রতি টান সবসময় ব্যস্ত রাখছে আমাদের। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কমছে। মনীষীদের জীবনী পড়ছি না, ইতিহাস মনে থাকছে কই? তাই যৌথতাও হচ্ছে না। এছাড়াও আমরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে সেটিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলছি। কাজেই সেই বিভেদের বেড়াজাল টপকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কোন কোন শিল্পীর কাজ আপনার ভালো লাগে?
অনেকেই আছেন সেই তালিকায়। শম্ভূ মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুণ্ডু, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় তো আছেনই। এছাড়াও ভালো লাগে উর্ম্মিমালা বসু এবং জগন্নাথ বসুর কাজও।
রিয়্যালিটি শো কি শিল্পী তৈরি করে নাকি তারকা তৈরি করে?
শিল্পীর নিজস্বতাটুকুকে মেরে ফেলে অবশ্যই তারকা তৈরি করে রিয়্যালিটি শো। বাণিজ্যিক প্রযুক্তির সঙ্গে জোর করে খাপ খাইয়ে গ্রুমিং সর্বস্য, গ্ল্যামার সর্বস্য তারকা তৈরি করছে। সেই তারকারা আবার দাবী করেন, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ গানটি দেশবাসীর মনের ভাব প্রকাশে অক্ষম(হেসে ফেললেন)।
মুহূর্তের ডাক নাকি এক্সপেরিমেন্টের তৃষ্ণা? শিল্পী হিসেবে কোনটি আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
অবশ্যই দ্বিতীয়টি। মৌলিক ও পরীক্ষামূলক কাজই শিল্পীকে শিল্পী তৈরি করে। কপি-পেস্ট সংস্কৃতি শিল্পসত্ত্বাকে নষ্ট করে। কারণ আমার নিজস্ব শেখা বাঁ জানাকে আমি যতক্ষণ না চ্যালেঞ্জ করছি, সেটি আমার মতো করে একটি শিল্প হচ্ছে কই?
বাচিক শিল্পী হিসেবে আপনি কী কী কৌশল অবলম্বন করেন? আপনি অনুশীলনই বা কীভাবে করেন?
বলবো না। কবিতা পড়ি প্রচুর এবং তার ভাব-নির্যাসটুকু নিজের মধ্যে নিয়ে নিই।
দীর্ঘ পথ চলায় পিয়ালী পাঠকের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করুন।
অভিজ্ঞতা তো প্রচুর হয়েছে। তবে একটি বিষয় শেয়ার করবো। নন্দন কলা এবং দৃশ্য কলা দুইয়েরই কিন্তু মৌলিক চিন্তার মাধ্যমে প্রকাশ প্রয়োজন। আমার একটি অভিজ্ঞতা মনে থাকবে আজীবন। কলকাতার স্টার থিয়েটার হলে প্রথম যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে একটি মৌলিকতায় ভরা অনুষ্ঠান পরিবেশনা করা। যেখানে প্রচুর মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কি-বোর্ড বাজলো না। তাহলে আবহসঙ্গীত হল কই? এটা বুঝি আবৃত্তির ব্যান্ড। তারা বোঝেন নি, যে শুধু মাত্র কি-বোর্ড নয়। কিছু লাইভ যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহার করেও অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করা যায়।
বাচিক শিল্পী হিসেবে আপনার উপলব্ধি কী?
কথা বলা যতো সুন্দর ও ভাব-সর্বস্ব হবে তার গ্রহণযোগ্যতা ততোই বাড়বে মানুষের কাছে। তবে বাচিক শিল্পের প্রচুর শাখা। সব শাখাগুলিতে বিচরণ এখনও করে উঠতে পারিনি। তাই উপলব্ধিটা এখনও পুরোপুরি আসেনি।
বাচিক শিল্পী হিসেবে পিয়ালী পাঠকের স্বপ্ন কী?
স্বপ্ন একটিই। কবিতার মতো সত্য, সুন্দর, প্রেমময়, বিদ্রোহময়, ছন্দময়, ভাবময় জীবন হোক সকলের। কবিতা শোনার, পড়ার ও বোঝার অভ্যাস বাড়ুক।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS2020.10.20মানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS2020.06.09ফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS2020.05.25ঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS2020.04.19লকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!