কলমে সংঘমিত্রা দে
পাহাড়, পর্বত, মরুভূমি, নদনদী মিলেমিশেই তো জগতের বাহার। মানচিত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গও সামিল এই বাহারে। কিন্তু উত্তরবঙ্গ মানেই কি কেবল দার্জিলিং, কালিম্পং বা ডুয়ার্স? হিমালয়ে ঘেরা উত্তরবঙ্গের মানচিত্রে পেডংয়ের উল্লেখ থাকলেও, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তার তেমন সুপরিচিতি নেই। সেই পেডংই হল আমাদের এবারের গন্তব্য। যাত্রাপথে সহযাত্রী আমার বোন।
এক গ্রীষ্মের সকালে পৌঁছলাম নিউ জলপাইগুড়ি জংশন স্টেশনে। শুরু হল পেডং যাত্রা। সমতল ছেড়ে এক পাহাড় ছুঁয়ে অন্য পাহাড়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। পাহাড়ের মনোরম সান্নিধ্য গরমেও এনে দিলো স্বল্প শীতের আমেজ। যাত্রাপথের বাঁ-দিকে উচ্চতার হাতছানি আর ডানদিকে বয়ে চলেছে তিস্তা তার আপন খেয়ালে। একসময় তিস্তা দৃষ্টির অগোচরে চলে গিয়ে দেখা দিল ছোট ছোট জনপদ। অবিরাম পথ চলা, যাত্রাসুখের উল্লাসে হারিয়ে গেল পথের শ্রান্তি।
জনবহুল শহর কালিম্পং। ডেলো আর দূরবীন দ্বারা দুই পাহাড়ের মাঝে ফুল আর অর্কিডের দেশ স্কটিশ মিশনারিদের হাতে গড়া কালিম্পং সুদূর অতীতে সিকিম তথা তিব্বতের সঙ্গে ভারতীয় বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল। ডেলো পাহাড় আলগাড়া হয়ে অবশেষে পৌঁছলাম গন্তব্যে। লাভার রাস্তায় ইতিহাসের রেশমপথেই সেকালের বাণিজ্যিক শহর পেডং। ওক, পাইন, বার্চ আর দেবদারুতে ছাওয়া পেডং একটি শান্ত স্নিগ্ধ ছিমছাম জনপদ। লেপচা ভাষায় পেডংয়ের মানে বিশ্রামের জায়গা। এখানকার কর্মব্যস্তহীন চড়াই উতরাই পথে হেঁটে চলা, সবকিছুর মধ্যেই যেন সহজ সরল জীবন যাত্রার ইঙ্গিত।
এখানে ঘুরেফিরে একটাই পথ বাজার, স্কুল, কলেজ ছুঁয়ে পাহাড়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। পুরুষানুক্রমে নানা ভাষাভাষী ব্যবসায়ীদের সমাগম এখানে। এক বাঙালি ব্যবসায়ী নিমাইদার সঙ্গে আলাপচারিতায় পেডংয়ের পাশের গ্রামগুলির জীবনশৈলীর একটি স্পষ্ট ধারণা পেলাম। এই স্থায়ী বাসিন্দার বাড়িতে আশপাশের গ্রামের কয়েকজন নেপালী ছাত্রছাত্রী পড়াশুনার জন্য থাকে এবং নিজেরাই রান্না করে খায়। চাল, ডাল, গ্যাস আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান দেন নিমাইদা। অসুস্থ হলে ডাক্তার-ওষুধের দায়িত্বও তার কাঁধে। বাৎসরিক খরচ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা তাকে আনুমানিক ৩০-৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দেয় বড় এলাচ, আদা, গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে নিয়ে আসা গরুর দুধ। অতীতের বিনিময় প্রথা আজও পাহাড়ের জনজীবনে বেঁচে রয়েছে দেখে অবাক হলাম।
পেডংয়ে রয়েছে ১৮৩৭ সালে ভুটানিদের গড়া পেডং মনাস্ট্রি এবং ব্রিটিশের হাতে বিধ্বস্ত ভুটানিদের ১৬৮০ সালের ডামসিং দুর্গ। পেডং থেকে কাশিং যাওয়ার পথে ৫৪০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে ক্রশহিল। নৈসর্গিক শোভাই এখানকার মূল আকর্ষণ। রাজ্য পর্যটনের আনুকূল্যে এখানে গড়ে উঠেছে কিছু হোম-স্টে। যাত্রাপথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সিকিমের পাহাড়গুলি। আদা এবং বড় এলাচের বাগানও হাজির। সুদূর অতীতের ভগ্নপ্রায় প্রাচীন রেশমপথ ধরেই আমাদের যাত্রা এবার কালিম্পং অভিমুখে। ডেলো পাহাড়ে তিব্বতী বৌদ্ধ মনাস্ট্রির দেয়াল জুড়ে ফ্রেস্কো চিত্রের সমাহার। উপাসনা মন্দিরে ধ্যানগম্ভীর বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও লামাদের পঠনপাঠনের বিদ্যালয় ঘিরে সর্বত্রই রয়েছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া।
বৃষ্টিস্নাত পেডংয়ের সঙ্গে ঝলমলে রোদ্দুরের লুকোচুরি চলছে অবিরাম। মেঘের আনাগোনার মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি, আবার আকস্মিক মিষ্টি রোদের ছোঁয়া। এই নিয়েই খুশি পেডংবাসী। এবার আমাদের ফেরার পালা। দিন সাতেক কাটিয়ে একই পথ ধরে নেমে এলেও পাহাড়ি পথে নেই কোনও একঘেয়েমী। তাই চেনা জীবনটাই হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠেছিল পেডংয়ের সৌজন্যে। অবশেষে ফিরে আসতে হল সংসার জীবনের কর্মব্যস্ত প্রেক্ষাপটে।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS3 weeks agoপদ্ম-দুর্গে ঘাসফুলের শিকড় মজবুত করতে যাচ্ছেন অভিষেক, গঙ্গারামপুর স্টেডিয়ামে চলছে শেষ লগ্নের প্রস্তুতি!
EXCLUSIVE NEWS4 months agoপুজোয় বয়স্করা কীভাবে আটকাবেন মারণ-রোগকে? শ্রীরামপুর আইএমএ দিল তারই হদিশ!
EXCLUSIVE NEWS4 months agoদলীয় পতাকার বাইরে ভাবতে শিখল আরামবাগ, সাধারণ পড়ুয়াদের ধর্ষণ বিরোধী স্লোগান আছড়ে পড়ল রাজপথে!
EXCLUSIVE NEWS4 months ago‘একুশে বামফ্রন্ট’! নিছক ফেসবুক গ্রুপ নয়, এ যেন ফ্যাসিস্ট মানসিকতার বিরুদ্ধে যৌথতার ব্যারিকেড!