কোটা নামটা শুনলেই যে কথাটা সবথেকে আগে মনে পড়ে সেটা হল শাড়ি। হ্যাঁ , কোটা শাড়ি। রাজস্থানের কোটা শহরেই তৈরি হয় এই শাড়ি। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। তার আগে আসুন একটু ঘুরে দেখে নেওয়া যাক রাজস্থানের এই মরু শহরটিকে। ক’দিন আগেই ওখানে গিয়েছিলাম ছেলের সাথে দেখা করার জন্য। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শান্তিপ্রিয় শহর। গোটা শহরে শুধু কোচিং সেন্টারের বড়ো বড়ো হোডিং , ফ্লেক্স আর পোষ্টার ! ‘বনসল’ , ‘রেশনেন্স’ , ‘ভাইব্রেন্ট’, ‘এলেন’ এমন আরো অনেক আবাসিক কোচিং সেন্টার! হাজার হাজার কিশোর কিশোরীদের মোটা টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আইআইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। সেরকমই এক কোচিং সেন্টারে আমার ছেলে ভর্তি হয়েছে কয়েক মাস হ’ল। ওর সঙ্গে দেখা করার সুবাদেই আমার এখানে আসা।
নির্দিষ্ট দিনে কোটা পৌঁছে ছেলের হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। পরদিন সকালে ও ক্লাস করতে বেরিয়ে গেল।আমি বসে বসে বোর হচ্ছিলাম। ভাবলাম কোটা শহরটা একটু ঘুরে দেখে আসলে মন্দ হয়না। নেট সার্চ করে মোটামুটি আন্দাজ করে নিলাম এখানে দর্শনীয় স্থান কী কী রয়েছে। ব্যাস, সাথে সাথেই তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই একটা অটো বুক করে ফেললাম । কথা হ’ল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কোটা’য় দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরিয়ে দেখাবে । দরদাম করে ৮০০ টাকায় রাজি করানো গেল অটোওয়ালাকে। প্রথমেই গেলাম সরকারি মিউজিয়াম। এখানেই রয়েছে কোটা রাজবাড়ি, যার নাম ‘বাদল মহল’। এখানকার রাজা উমেদ সিং এর রাজত্বকালের (১৮৮৮-১৯৪০) বিভিন্ন অমূল্য তৈলচিত্র ও বিভিন্ন রকমের দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। গেটে ঢোকার মুখে তিনটে রাজকীয় কামান সাজানো। টিকিট কেটে মূল গেট দিয়ে ঢুকতে হল। মিউজিয়ামের প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা আর ছবি তোলার জন্য ৫০ টাকা অতিরিক্ত।
ভেতরে ঢুকতেই দৃষ্টিগোচরে এলো বিশাল সুরম্য রাজ প্রাসাদ যেটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় য এটির যথেষ্টই যত্ন নেওয়া হয়। চারদিকে সিকিউরিটি গার্ড, পুলিশ আর গাইড। মাঝখানে বিরাট প্রাঙ্গনকে ঘিরে চকমেলানো রাজমহল! মিউজিয়াম এ ঢুকতেই প্রথম যে জিনিসগুলোতে আমার দৃষ্টি আটকে গেল আজ সেগুলো নিয়েই বলব।
প্রথমেই দেখলাম ওয়াটার ক্লক বা জলঘড়ি। বইতেই ওয়াটার ক্লক এর কথা পড়েছিলাম। কখনো চোখে দেখিনি! একটা জলভরা পাত্রের উপর একটা খালি তামার বাটি ভাসছে। কী ভাবে সময় নির্ধারণ করে ! গাইড’কে জিজ্ঞেস করায় বললেন, বাটির তলায় ছিদ্র আছে। পুরোটা যখন ডুবে যাবে তখন এক ঘড়ি বা এক ঘণ্টা। বাহ দারুন ব্যাপার তো ! মানুষের সৃজনী শক্তি ও বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। পাশেই দেখলাম একটা বিশাল গোলাকার লোহার বলয়ে’র মত জিনিষ, তাতে লেখা গোল যন্ত্র। যন্ত্রটার মধ্যে অনেকগুলো সংখ্যা লেখা। গাইডকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা জোত্যিষ বিদ্যার কাজে ব্যবহৃত হত।
এরপর দেখলাম আইসক্রিম মেশিন। একটা লোহার বাক্সের মত, পাশে বাক্সটিকে ঘোরানো’র জন্য আছে একটা হ্যান্ডেল। বাক্সের মধ্যে বরফ এর কুঁচি দিয়ে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আইসক্রিমের পাত্রগুলিকে ঠান্ডা করে জমানো হত। আইসক্রিম বানানোর কী অদ্ভূত পদ্ধতি! এরপর আরো বিস্ময়কর যেটা দেখলাম সেটি হল ওয়াশিং মেশিন। এখনকার মতই ছিল। তবে ছোট একটা ওয়াশ চেম্বার রয়েছে পাশে। পাশে পাম্পের একটা নলও রয়েছে। যদিও ঠিক করে বুঝলাম না এই পদ্ধতিটা।
এরপর আরো অবাক হলাম কেরোসিন তেলের ফ্যান দেখে! বিদ্যুৎ ছিল না সে যুগে। তাই কেরোসিন তেল দিয়ে ফ্যান চালানোর এই অভিনব উপায় উদ্ভাবন করেছিল মানুষ। ভাবা যায়! দু’শো বছর আগেও কত আধুনিক মনস্ক ছিল মানুষ। তখনকার তালাচাবির পদ্ধতিও দেখলাম। এতো বছর আগেও মানুষের ওইরকম চিন্তাশক্তি আমাকে অবাক করল।
এরপর মিউজিয়াম এর ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো মহারাজা স্যার উমেদ সিং এর প্রায় দশ ফুটের মতো বিশাল পাথরের মূর্তি । সামরিক পোশাক পরিহিত সিল্কের চাদর গায়ে পূর্ণাঙ্গ মূর্তি । রাজকীয় পৌরুষ আর আভিজাত্যের মেলবন্ধন ! পরের পর্বে বলছি মহারাজা উমেদ সিং এর কথা।
Author Profile
