চিত্র ঋণ – inextlive.jagran.com
গঙ্গারামের নাম শুনে অনেকেরই হয়তো সুকুমার রায়ের লেখা ‘সৎপাত্র’ কবিতার অযোগ্য পাত্র গঙ্গারামের কথাই মনে পড়বে। যদিও আমার গল্পের হিরো গঙ্গারাম অযোগ্য তো ছিলই না, বরং ছিল সকলের চোখের মণি। বেশ কিছুদিন আগে আমি ‘জঙ্গল বুক’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিলাম যেখানে মোগলি নামে একটি তেরো/চোদ্দ বছরের কিশোরের বন্ধু ছিল ভালুক, ব্ল্যাক প্যান্থার, শেয়ালের মতো হিংস্র পশুরা। কী অটুট ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল মোগলি ও জঙ্গলের ওই হিংস্র পশুগুলো।
এ তো গেল রূপকথার গল্প। বাস্তবেও কি এমন ঘটনা সম্ভব? আজ্ঞে হ্যাঁ, সেটাই সম্ভব করে দেখিয়েছে ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর থেকে ৮০ কিমি দূরে বেমেত্রা জেলার বাওয়ামোহাত্রা গ্রাম। সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা ছোট্ট গ্রামটির মাঝখানে রয়েছে এক বিরাট দীঘি। এই দীঘিতেই বাস করতো ১৩০ বছর বয়সী এক কুমির। গ্রামবাসীরা আদর করে যাকে গঙ্গারাম বলে ডাকতো। কুমিরটি ছিল ৩.৪ মিটার লম্বা, ওজন ছিল প্রায় ২৫০ কেজি। কেউ সঠিক জানেনা গঙ্গারাম কবে থেকে এখানে আছে বা কীভাবে এলো। জনৈক গ্রামবাসীর কথায় তাদের তিন প্রজন্ম আগে থেকেই গঙ্গারাম এখানে ছিল। গঙ্গারাম ছিল গোটা গ্রামের আপনজন, ঘরের লোক। গ্রামের বাসিন্দাদের থেকেই জানা যায় যে, গঙ্গারাম ছিল খুব সংবেদনশীল ও সমঝদার।কখনও কারোর ক্ষতি করেনি। ছোট থেকে বড় সকলের বন্ধু ও আপনজন ছিল সে। এতটাই সমঝদার ছিল যে দীঘিতে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা মহিলা স্নান করতে নামলে গঙ্গারাম লজ্জা পেয়ে অন্য দিকের ডাঙায় উঠে যেত। গ্রামের বাচ্চারা নির্ভয়ে তার পিঠে চড়ে দীঘির এপার ওপার করে খেলা করতো। যখন গঙ্গারামের খিদে পেত জলের মধ্যে ওর গোঙানির শব্দ শোনা যেত, জলের উপর বুদবুদ দেখা যেত। বাওয়ামোহাত্রার বাসিন্দারা তখন পরম মমতায় তাদের আদরের গঙ্গারামের জন্য ভাত, ডাল, তরকারি সাজিয়ে নিয়ে দিঘির পাড়ে রেখে আসতো। কেউ যদি গঙ্গারাম এর নাম ধরে ডাকতো তাহলেও জলে ভেসে উঠে বা ডাঙায় উঠে লেজ ঝাপটিয়ে জানান দিতো উপস্থিতি। গ্রামের সরল মানুষগুলো গঙ্গারামকে তাদের আরাধ্য দেবতার ঠিক পরেই স্থান দিয়েছিল। এমনকি তারা এই কুমিরটিকে তাদের রক্ষাকর্তা ভাবতো এবং রীতিমতো পুজো করতো।
চিত্র ঋণ – indiatoday.in
বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্য রয়েছে ‘কুমিরের কান্না’। যদিও কুমিরের জন্য একটা গোটা গ্রাম কেঁদে ভাসাচ্ছে এমন ঘটনা বোধ হয় বিরল। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি জনৈক গ্রামবাসী দীঘিতে স্নান করতে নামেন। সেই সময় গঙ্গারাম জলে ভেসে ছিল।অনেকক্ষণ গঙ্গারামের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে গ্রামবাসীটির সন্দেহ হয়। সে গ্রামে গিয়ে খবর দেয়। মুহূর্তে গোটা গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে সকলে মিলে গঙ্গারামের নিথর দেহ ডাঙায় তোলে। গঙ্গারাম এর প্রাণহীন দেহটাকে ধরে সকলের কী কান্না! বনবিভাগের লোক এসে গঙ্গারামের দেহ ময়না তদন্ত করে জানায়, স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত কারণেই এই মৃত্যু। দেহটি গ্রামের মানুষের হাতেই তুলে দেয়া হয়। সাধারনতঃ আমাদের কোনো প্রিয়জন চলে গেলে আমরা তাকে ফুল চন্দনে সাজিয়ে কাঁচের গাড়িতে শুইয়ে জলভরা চোখে শেষ বিদায় জানাই। গঙ্গারামকেও তেমনই সিঁদুর ও ফুলের মালায় সাজিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো ট্রাক্টরে শুইয়ে শেষ বিদায় জানানো হয়। দীঘিরই একপাশে তাকে সমাধি দেয়া হয় ।সেদিন আর গ্রামের কোনো মানুষের ঘরে উনুন জ্বলেনি। গ্রামের মোড়ল জানান, গঙ্গারামের স্মৃতি সৌধ হিসেবে তার সমাধির উপর একটা মন্দির বানানো হবে এবং সেখানে গঙ্গারাম এর একটা মূর্তি তৈরি করা হবে। মানবিক কুমিরটির স্মরণে গ্রামের নতুন নামকরণ হবে ‘মগর মাচ্ছা ভালা গাও’। এখনও গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করেন যে, গঙ্গারামের পার্থিব শরীর না থাকলেও গঙ্গারাম তাদের সঙ্গেই রয়েছে। যে কোনও বিপদে সে তাদের রক্ষা করবে। কী অগাধ বিশ্বাস এই সরল মানুষগুলোর!
কত অদ্ভুত ঘটনাই তো ঘটে পৃথিবীতে। ভালোবাসার কী অসীম ক্ষমতা, হিংস্র প্রাণীও সহৃদয় হতে পারে। আমরা দেখছি কত নির্দয়ভাবে, নির্বিচারে অবলা প্রাণীকে মারতে একদল শিক্ষিত মানুষের একটুও হাত কাঁপে না। আবার একই পৃথিবীর এক অখ্যাত গ্রামে গঙ্গারামের মতো প্রাণীও কীভাবে মানুষের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা ও মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে পারে। শেষে একটাই কথা বলবো। হিংস্র প্রাণী না হোক, অন্ততঃ আমাদের চারপাশে যে অবলা প্রাণী আছে তাদের যদি আমরা একটুও মায়া-মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিই তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে? কে বলতে পারে? হয়তো এভাবেই ভবিষ্যতে আরও অনেক গঙ্গারাম আমাদের আপনজন হয়ে উঠবে!
Author Profile
