প্রথমে আসে ট্রোল, তারপর বুনো ওল, তারপরে…মনে হয় ট্রোল-সম্রাট গর্গ চ্যাটার্জী। বাংলা পক্ষের অন্যতম এক সহযোদ্ধা তিনি। বাজার ভোটের হোক, অথবা নাই বা হোক, নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেরকম রোজ টানা বৃষ্টিপাত হবেই। তেমনি গর্গ চ্যাটার্জীর বক্তব্য নিয়েও তোলপাড় এ বাংলার বুকে হবেই। কেউ ব্যাঙ্গ করে বলেন তৃণমূল কংগ্রেসের ‘বি’ টিমের ক্যাপ্টেন, তো কারোর মতে বাঙালি জাতির আঁতেল পিতা। কেউ বা তাকে অথবা বাংলা পক্ষকে তোপ দেগে বলেন বাংলা মৌলবাদী বা পক্ষী। তবে যে যাই বলুন, শুধু বাংলা পক্ষের চোখেই নয়, গর্গ দা এই মুহূর্তে অনেক বাঙালির আদর্শ। তাই মারাত্মক ইচ্ছে হলো মানুষটিকে জানতে, তার ভাবনা বুঝতে। সেই সঙ্গে আমাদের গণমাধ্যমের একটি অন্যতম দায়, বিতর্ককে নিরপেক্ষ চোখে আমাদের পাঠকের কাছে পরিবেশন করা। একেবারেই সেই জায়গা থেকে বিরোধী পক্ষের ছোঁড়া কাদার ডেলা প্রশ্নের প্লেটে সাজিয়ে আমরা হাজির হলাম গর্গ চ্যাটার্জীর বাসভবনে। সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে কোনও কাঠখড় পোহাতে হয়নি, এদিক দিয়ে তিনি আবার মাটির মানুষ। তাহলে দেখা যাক, প্রশ্নের চক্রব্যূহে তাকে ঘিরে ফেলার পরে কী হল?
“বাঙালি ঘরের শিক্ষিত মেয়েরা ডাগর হলে হরিয়ানা, দিল্লি, গুরগাঁওতে হিন্দি পুরুষ ঘরে সাপ্লাই করাই বাংলায় দিল্লি বোর্ডের কাজ”। অতি সম্প্রতি ফেসবুকে আপনার এই পোস্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি নারিবিদ্বেষী বক্তব্য মনে হচ্ছে। কেন এরকম লিখেছেন আপনি?
উত্তরটি শোনার জন্য বামদিকের অডিও চালু করার বোতামটি টিপুন
কেন বাংলা পক্ষের মতো একটি সংগঠন গড়ে তুলতে হলো?
বাংলা পক্ষ আমরা কয়েকজন তৈরি করেছিলাম। তার কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম বাঙালি জাতি চারিদিকেই তার অধিকার হারাচ্ছে। চারিদিকেই সে মার খাচ্ছে, লুণ্ঠিত হচ্ছে, চাকরি নেই তার হাতে। ক্রমাগতঃ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ এবং হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বাঙালি দিশেহারা। এই কথাগুলো সকলেই জানতেন, কিন্তু শুধুমাত্র ফিসফাস চলতো। অথচ এই ফিসফাসটাই গণপরিসরে জোর গলায় উঠে আসার দরকার ছিল। শুরু করেছি আমরা, কিন্তু এটি শুরু হতোই। আমরা না করলেও আর কেউ হয়তো শুরু করে দিতো। এক্ষেত্রে আমাদের কোনও নতুনত্ব বা বিশেষত্ব নেই। রাস্তায় নামলে একটা কথা আমরা বারবার শুনতে পাই, “অনেক আগেই দরকার ছিল।”
আপনারা তৃণমূল কংগ্রেসের ‘বি-টিম’, এটি কি সত্যি নাকি নিন্দুকদের কুৎসা?
আমরা ব্যাক্তিগতভাবে নানা দলের সমর্থক রয়েছি। এটি নির্বাচনী দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের একটি বাস্তবতা আছে। তবে বাংলা পক্ষ কোনও নির্বাচনে লড়া সংগঠন নয়। এই সংগঠন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগঠন। সেখানে নানা দলের সমর্থকরা মিলেমিশে রয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক আছে, যেমন আমি। সিপিএম সমর্থক আছেন, এসইউসিআই বা কংগ্রেস সমর্থকও আছেন। এমনকি অতি-বাম সমর্থকও রয়েছেন। এখন সরকারে তৃণমূল আছে, কাল হয়তো সরকারে অন্য কোনও দল থাকবে। আগের সরকারে বাংলার দল সিপিএম ছিল। কিন্তু বাঙালি জাতির অধিকারের প্রশ্নে আমরা এক। এই যে যাদবপুরে আমরা ডোমিসাইল করলাম, বাংলার পড়ুয়াদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৯০% আসন সংরক্ষিত হল। সেখানে সরকারের মন্ত্রী বা আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে না? আমরা তো শুধু লড়াই করার জন্য লড়াই করতে আসিনি, আমরা জিততে চাই। সেই জায়গায় একটি সরকারী দল, এটি একটি বাস্তবতা। তার একটি জনভিত্তি রয়েছে।
আগে যে কলকাতা লিগ হতো, যেটিকে বর্তমানে কার্যত শেষ করে দিয়েছে ধোকলা-ভুজিয়া পুঁজিবাদ। সেই কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান রেষারেষি করে খেলতো, আবার দু’দলের সেই খেলওয়াড়রাই সন্তোষ ট্রফিতে একে অপরকে পাস দিয়ে গোল করাতো। এটিই বাংলা পক্ষের আদর্শ। দল হল কাপড়, বাঙালি হল চামড়া।
মালদা জিকেসিআইটির পড়ুয়ারা কেন্দ্রীয় সরকারে প্রতারণার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে লড়ছিল আপনারা পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের বেসুতেও এক বাঙালি গবেষক ছাত্র মার খাওয়ার পর আপনারা সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে তাকে ফোন করেছিলেন। অথচ এসএসসি আন্দোলনে অসংখ্য বাঙালি চাকরিপ্রার্থীরা অনশন করার সময় বাংলা পক্ষকে পাশে পায় নি। এমনকি প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের মারোয়াড়ি উপাচার্য তিন ছাত্রকে অন্যায্য কারণে সাসপেন্ড করেছিল, সেই ছাত্রদের অনশন চলাকালীনও আপনারা চুপ থেকেছেন। কেন?
আমরা ‘ডোমিসাইল বি’ নীতি, যেটি রাজ্য সরকার চালান শিক্ষাক্ষেত্রে, আমরা সরাসরি এই নীতি বদলের জন্য আন্দোলন করেছি। যাদবপুর সহ একাধিক রাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমরা এই আন্দোলন করেছি। বিহারে যদি বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকে তাহলে এখানে হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় কেন, সেই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছি। এই সবকটি ক্ষেত্রেই আমরা রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছি। পশ্চিমবঙ্গ তো ক্যাটিগরি সি স্টেট, এখানে তো হিন্দি কোনোভাবেই বাধ্যতামূলক হতে পারে না।
এখানে একটি ব্যাপার বুঝতে হবে যেখানে বাঙালি আসলে বাঙালি বলেই নিপীড়িত সেখানেই আমরা আছি। আমি কারও টাকা ধার নিয়ে ফেরৎ দিলাম না, এটি তো বাংলা পক্ষের কেস নয়, সেটি সামাজিক-ব্যাক্তিগত কেস। এসএসসি আন্দোলনকারীদের দাবী মানা হয় নি সেটি কিন্তু তারা বাঙালি বলে মানা হয়নি এরকমটা নয়। প্রেসিডেন্সির ছাত্ররাও কি একবারও দাবী করেছে যে বাঙালি বলে তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছিল? মালদা জিকেসিআইটির ক্ষেত্রে এটি বাংলার একটি কলেজ যার সঙ্গে বঞ্চনা করেছে কেন্দ্র। সেই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বাঙালির কোটা কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। টার্গেট করে বাংলা বা বাঙালি কি আক্রান্ত? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে বাংলা পক্ষ পাশে আছে।
শেখর দুবে নামের এক সাংবাদিকের প্রোফাইলে লেখা, “আমি একজন খোট্টা যার মাতৃভাষা বাঙালি”। এই ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য?
শেখর ডুবে, কে আমি জানিনা। তবে সে যদি খোট্টাই হয়, তাহলে সে একজন খোট্টা। সে তো নিজেকেই খোট্টা বলছে, তাহলে সে খোট্টাই নিঃসন্দেহে। খোট্টা তো একটি ভাষার নাম। কথাটা হচ্ছে নামে নয়, ব্যাবহারে। একজন খোট্টার মাতৃভাষা বাংলা হতেই পারে। কিন্তু যদি সে সাম্প্রদায়িক হয় তাহলে তো সে নরকের কীট, তাহলে সে অসভ্য। বাঙালি একটি সভ্য জাতি। তাহলে সে দালাল, কারণ বাঙালি একটি সোজা শিরদাঁড়ার জাতি।
বাংলা পক্ষের অন্যতম একটি স্লোগান, “বাঙালি ভোটব্যাঙ্ক হয়ে ওঠো” – এর ব্যাখ্যা কী?
উত্তরটি শোনার জন্য বামদিকের অডিও চালু করার বোতামটি টিপুন
শুরু হয়ে গিয়েছে লোকসভা নির্বাচন। এবারে বিজেপির জিতে ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা ঠিক কতোটা?
আমি বাংলার বাস্তবতা নিয়েই থাকি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিহার-উত্তরপ্রদেশের জনগণ যা মনে করে তার ওপরেই এই বাংলায় বাঙালির ভাগ্য নির্ভর করে। গল্পটা হচ্ছে, সবরকম ফলের জন্য বাঙালি জাতিকে তৈরি থাকতে হবে। প্রশ্নটির মধ্যে রাজনৈতিক সেফোলজির একটা ধাঁচ ছিল। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি মোদী জিতছেন না। রাস্তায় যখন একটা বাঁদর মরে তখন তো পয়সাওয়ালা কাউকে ফোন করতে লাগেনা। বাংলা জুড়ে এতগুলো ডিজে বক্স, এতগুলো ফেসবুকের ফেক অ্যাকাউন্ট, তারপর সারাদিন ফেক উস্কানিমূলক ভিডিও তৈরি হচ্ছে এর তো একটা পয়সা লাগে নাকি? এই বাংলায় পয়সা কার? আমি এর উত্তর দেবো না, বাঙালি জানে…এই বাংলায় পয়সা যার, এসব নাটকও আসলে তার। এসব বাংলা ও বাঙালি বিরোধী ষড়যন্ত্রও তার। কাজেই আমরা তো ঘরপোড়া গরু, যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে। ৪৭ থেকে খালি অধিকার গিয়েছে, আসেনি কিছুই।
পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর মুচি, কুলি, মজুরের মতো খেটে খাওয়া মানুষ রয়েছেন যারা হিন্দিভাষী। তাদের আপনি কোন চোখে দেখেন?
তাদের আমি সেই চোখেই দেখি ঠিক যেই চোখে বিহারে, উত্তরপ্রদেশে, হরিয়ানায় যে চোখে হিন্দিভাষীরা বাঙালিকে দেখে। খুব সহজ উত্তর।
আপনারা প্রায়শই বলেন বড়বাজার থেকে ব্যাবসার দখল ছিনিয়ে নেওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে ক্লাসের ফার্স্টবয়কে মেরে ধরে তাকে হারিয়ে প্রথম স্থান দখল করার পক্ষে নাকি সুস্থ প্রতিযোগিতায় ফার্স্টবয়কে হারিয়ে বাঙালির জেতাটা আপনার কাছে কাম্য?
এই রূপকটায় আমার সমস্যা আছে। প্রথমত, এটি আমার মাটির ওপরে নারকেল গাছ। গাছের নারকেল গুলিও আমার। এটা কোনও ক্লাসের প্রতিযোগিতা নয়। পৃথিবীর আর কোনও মাটিতে নারকেল গাছ আমার নয়, শুধু এই মাটিতেই তা আমার। কাজেই নারকেলের আমি মালিক। ভুজিয়া-ধোকলা পুঁজিবাদ নির্বিচারে বাজার দখল করে বলে আমরাও সেটা করবো তা নয়। আমাদের বাজার আমরা ঠিকই দখল করবো। আমরা এমন স্বদেশী করবো যে অনেকের স্বদেশের কথা মনে পড়ে যাবে।
একটি অবাঙালি ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে একটি বাঙালি ছেলে বা মেয়ের প্রেমের সম্পর্ককে আপনি কোন চোখে দেখেন?
পৃথিবীর দুটি মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াবে সেক্ষেত্রে আমার মতামত বা সমর্থনের প্রশ্নই আসছে না। কিন্তু আমরা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের যে রাজত্বে বাস করি, সেখানে চারটি অক্ষ বা ব্যাপার থাকে। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত জাতির পুরুষ হল স্ত্রৈণ, যৌনভাবে দুর্বল। নিপীড়িত জাতির নারীর যে নির্মাণ ঘটায় সাম্রাজ্যবাদ তা হল, সেই নারীরা পিপাসিত এবং ভীষণরকম আকর্ষণীয়। তাদের যৌন লালসা প্রচণ্ড কিন্তু সেটি তাদের স্বজাতির পুরুষ দ্বারা নিবারিত নয়। এবার আসি সাম্রাজ্যবাদী জাতির পুরুষ, সে হল পৌরুষে ভরপুর। তাই সমগ্র নিপীড়িত জাতির নারীরা তাদের তৈরি পুঁজির কল্পনার বাজারের প্রোডাক্ট। শেষে আসি সাম্রাজ্যবাদের যে নারী তার স্থান ঘরে, তিনি পবিত্র অর্থাৎ মা অথবা স্ত্রী। এই নির্মাণের দ্বারা সমাজে আমাদের মাথায় তা গুঁজে দেওয়া হয় পর্নোগ্রাফি, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, মদেলদের মাধ্যমে, আইপিএল-বলিউডের মাধ্যমে ঢোকানো হয়। সেখানে আমরা এই আক্রমণের দ্বারা নির্ণায়িত হয়ে যাই। এই নির্ণয়ের বাইরে যে ভালোবাসা সেরকম সকল প্রেমকে আমি সমর্থন করি।
তাহলে আপনার কাছে হিন্দিভাষী মানেই খারাপ, হিন্দি মানেই কি শুধু সাম্রাজ্যবাদ? তার বাইরে আর কিছুই নয়?
হিন্দিভাষী মানেই খারাপ কেন হবে? সাড়া উত্তরপ্রদেশ বা বিহার জুড়ে তারা আছেন। তারা সবাই কি খারাপ? তারা তো ভালো লোক। তারা বাঙালিকে ভালো মনোভাবেই দেখেন। আমাদেরও মনোভাবও হিন্দিভাষীদের প্রতি খুব ভালো। তামিল মানেই কি সাম্রাজ্যবাদ? কন্নড় মানেই কি সাম্রাজ্যবাদ, গুজরাট মানেই কি সাম্রাজ্যবাদ? এই প্রশ্নটা তো আপনি করলেন না। তাই হিন্দি মানেই কি সাম্রাজ্যবাদ, এতেই লূকিয়ে রয়েছে প্রশ্নের উত্তর। বাংলার মাটিতে বিহারের যা আছে, তা বিহারের মাটিতে বাংলার যতোটুকু আছে তার থেকে যতো বেশি আছে, সেটুকুই হল সাম্রাজ্যবাদ।
বাংলা পক্ষের আগামী কর্মসূচী কী কী?
এই যে যাদবপুরের ডোমিসাইল যে পাস করালাম, তা উপাচার্য এখনও পাঠান নি রাজ্যের শিক্ষা দফতরে। সেটি আমাদের নজরে রয়েছে। উত্তর ২৪ পরগণা বাংলা পক্ষের সাবির এবং আজহারউদ্দীন বসিরহাটে স্টেটব্যাঙ্কে এটিএমে বাংলা আনার জন্য ডেপুটেশন দিয়ে এসেছেন। আমাদের একটি ব্যাবসা সংঘ তৈরির ইচ্ছেও রয়েছে। সেই নিয়েও কীভাবে লড়বো তারও নীল-নক্সা তৈরি হচ্ছে। রাজ্য সরকারী চাকরির ক্ষেত্রেও ডোমিসাইল এ চালু করা। অর্থাৎ বাঙালির জন্যই এরাজ্যের সরকারী চাকরির ৯০% থাকুক। সামনেই দিনেই এগুলো দেখতে পাবেন।
অসংখ্য হিন্দিভাষী রয়েছেন যারা বাংলায় জন্মে, সেই ভাষাতেই শিক্ষাগ্রহণ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অথবা প্রতিষ্ঠার পথে। তাদের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গী কী?
হিন্দিভাষীরা কাদের আপন মনে করেন তার একটা উপমা আগে দিই তাদেরই ভাষা দিয়ে। ওরা বলে ‘রোটি’ আর ‘বেটি’র সম্পর্ক, সেই হচ্ছে তাদের নিজের লোক। যার সঙ্গে বসে খায় এবং যার সঙ্গে বিয়ে-শাদি হয়। আমি ধর্মের এপার-অপারে যাচ্ছি না। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি, যারা সময়ের সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার ভাষাকে আপন করে নিয়েছেন, ঠিক যেরকম অন্যান্য হিন্দি রাজ্যে বাঙালি আপন করে নেয়। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এতে আবার দৃষ্টিভঙ্গীর কী আছে? প্রশ্নটা হচ্ছে সে বাঙালি হোক বা হিন্দিভাষী হোক, সে যদি ভূমিপুত্রদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যদি দাঁড়ায় বা কথা বলে তাহলে কিন্তু গল্প আলাদা। বাসে লেখা থাকে না, ‘আপনার ব্যাবহারই আপনার পরিচয়’, এখানেও গল্পটা তাই। ব্যাবহারে আমাদের একজন? নাকি ব্যাবহারে আমাদের কেউ না?
অন্য রাজ্য থেকে বাংলায় কোনও হিন্দিভাষী মানুষ চাকরি করতে এলে আপনি কি তার বিরোধিতা করেন? তাহলে একইভাবে বাঙালি যখন অন্য হিন্দিভাষী রাজ্যে চাকরি করতে গিয়ে তাদের চাকরি খেয়ে নিচ্ছে এমন অভিযোগও তো উঠতে পারে? কী বলবেন আপনি?
আচ্ছা, বাঙালি কি অন্য রাজ্যে চাকরি করতে গিয়ে সেখানে অফিসের মধ্যে সবাইকে দিয়ে বাংলা চালায়? স্থানীয় লোকেদের বাংলা বলায়? একটা বাঙালি কখনো জয়পুরে গিয়ে একটি কোম্পানি খুলে শুধুমাত্র বাঙালি কর্মী রেখে পাবলিক বিজ্ঞাপনে বলতে পারবে যে বাঙালি নেব না? পিস পিস করে দেবে। বাঙালির এসব জিনিসের ব্যাপারে কী মতামত তার জন্য আশপাশের রাজ্যগুলির পরিস্থিতি জরিপ করে নেওয়া ভালো। আমরা বাংলার ভূমিপুত্র। আমাদের বিশেষ অধিকার রয়েছে এই মাটিতে। আমরা এখানে লড়ে চাকরি, পুঁজি থেকে শুরু করে কারখানা যা আমরা বুদ্ধি করে, ঘাম ফেলে অধিকার করতে পারবো, সেগুলি আমরা দখল করবো। এমনকি শেষ অবৈধ পথটি, যেখানে ভগবানের ডালা বসবে সেইটিও। এটা আমরা যদি করতে পারি, তারপর যে কেউ আসুক তার নিজের কাজে। কোনও অসুবিধা নেই, স্বাধীন রাষ্ট্র।
আজ বাঙালির চাকরি নেই, তার জন্য কি সত্যিই হিন্দিভাষী রাজ্যের মানুষরা এখানে এসে চাকরি করছেন এই কারণটি দায়ী? নাকি এটি আসলে গোটা রাষ্ট্র তথা রাজ্যেরই সিস্টেমের সমস্যা?
পরিসংখ্যান বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালির চাকরি নেই। কিন্তু গল্পটা হল, বাংলায় চাকরি রয়েছে। এটাই হল বাংলা এবং বাঙালির একটি মজার জিনিস, বোঝার জিনিস। বাংলায় কী করে চাকরি আছে? বাংলার যে রাজ্য বাজেট তা হু হু করে বাড়ছে, বাংলার রাজ্য সরকারের রাজস্ব হু হু করে বাড়ছে। জিএসটিও প্রচুর বাড়ছে, তার মানে কেনা-বেচা হচ্ছে। মানুষ তো হাওয়া থেকে জিএসটি দেবে না? এই সার্কেল থেকে ইনকাম ট্যাক্স বেড়ে গিয়েছে হু হু করে। কলকাতা বন্দরে সব থেকে বেশি গ্রোথ হয়েছে অন্যান্য বন্দরের থেকে। এগুলো কিসের প্রমাণ? অর্থাৎ চাকরি রয়েছে। একটি প্রথম শ্রেনীর সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের করা সার্ভে অনুযায়ী, চাকরি তৈরিতে গোটা দেশে কলকাতার স্থান চার নম্বরে। এই সবকটি তথ্যই সত্য। কিন্তু বাঙালির ঘরে নেই চাকরি নেই, কারণ তাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি হিন্দিতে এবং ইংরেজিতে নেওয়া হয়, বাংলা প্রথমেই বাদ। অথচ হিন্দুস্থানীদের মাতৃভাষায় পরীক্ষা হচ্ছে, আমার মাতৃভাষায় হচ্ছে না।
এই যে আমাদের রাজ্যের টেন্ডার। আমাদের কয়েক কোটি টাকা লুঠ করে নিয়ে যাওয়া হয় বাইরের রাজ্যে। কয়লা খনির টাকা লুঠ করে, বন্দরের টাকা লুঠ করে। বাংলা তো কিছুই পায় না, এক্কেবারে ঝেড়ে ফাঁক করে দেয়। তার যে ছিটেফোঁটা টেন্ডারে আসে সেটাও দিল্লিকেন্দ্রিক সার্কেল করে পুরো সাট হয়ে যায়। একটা বড় টেন্ডার বাঙালি পায় না, একটা বড় চোরও বাঙালি নয়। কারণ ওই লেভেলের কানেকশন না থাকলে কি নীরব মোদিরা পালাতে পারে? এবার বাঙালি যদি টেন্ডার পেতো স্থানীয়দের চাকরি হতো স্বাভাবিকভাবেই। আমরা তো বলছি আমাদের টাকা আমাদের বুঝিয়ে দাও, বাকিটা আমরা বুঝে নেবো। কিন্তু আমাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার টাকা দিয়ে অন্য কাউকে চাকরি দেবে, তাহলে আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকাটা তৈরি করছি কেন? আমি যখন গুজরাতের বিরাট উপকূলের অ্যাডভান্টেজ আমি যখন পাইনা, আমার কয়লার অ্যাডভান্টেজ আমি কেন পাবো না? তোমরা ৪০ বছর ধরে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা মাশুল সমীকরণের মাধ্যমে আমাদের টাকা লুঠ করছো। আমাদের রাজ্যের কয়লা বাইরে গেলে এই মাশুল সমীকরণের জন্যই টাকা লাগতো না। কই দক্ষিণের তুলো আমাদের এখানে সুতোকলে এলে তো ঠিকই টাকা লাগে, সেখানে তো এই সুবিধা আমরা পাচ্ছিনা। কেন এটা হবে? এটাকে তো লুঠ করা বলে।
এবার আসি রাজ্য সরকারী চাকরির কথায়। এখানে কোনও ডোমিসাইল নেই। ফলে গ্রুপ ‘ডি’র চাকরির পরীক্ষায় ২২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সাড়ে ৫ লাখ অন্য রাজ্যের এসে পরীক্ষা দিল। এদের মধ্যেই আবার একটি গ্রুপ ফেরার সময় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন জ্বালিয়ে, ভাঙচুর করে দিয়ে গেল। ওদিকে বিহারে পরীক্ষা দিতে যাও, হিন্দি বাধ্যতামূলক করে রেখে দিয়েছে। এদিকে বাংলাটা পুরো ধর্মশালা। প্রাইভেট চাকরি? পুঁজি যার সবকিছুই তার, দোলে ছুটি দেয় না, হোলিতে দেয়। কালী পুজোয় ছুটি নেই, এদিকে দেওয়ালিতে ছুটি আছে। কলকাতার মতো জায়গায় একের পর এক এরকম অফিস দেখিয়ে দিতে পারি। তাদের একাংশ সবই নিজেদের লোকজনে চাকরি ভর্তি করে রেখেছে। এটাও জানিয়ে রাখি, নিজের বাড়ি যদি ফ্ল্যাট করে যদি বলে যে এখানে আমিষ খাওয়া যাবে সেটাও বেআইনী। এদের জায়গা সভ্য সমাজে নয়, জঙ্গলে, দ্বীপে কিংবা মরুভূমিতে থাকার কথা। এটা একটু অন্য প্রসঙ্গ হয়ে গেল, অথবা প্রসঙ্গ আছে, যিনি পড়বেন তিনি বিচার করবেন। কিন্তু বাঙালি নেবো না, এরকম সরাসরি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বাংলা পক্ষ সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ করে এসব সংবিধান-বিরোধী কাজের প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু সেটা করেও তো খুব একটা লাভ নেই, ৯০% তো আন্ডারগ্রাউন্ডে হচ্ছে। মোট কথা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিকে পুঁজির দখল নিতে হবে। মহারাষ্ট্রে যদি কোনও কোম্পানি বলতো যে মারাঠা নেবো না, আস্ত থাকতো? বিহারে যদি একটা কোম্পানি খুলে বলতো যে বিহারী নেবো না, আস্ত থাকতো সেই কোম্পানি? আবার বলছি, আমরা এখানে এখানে আমাদের বিশ্বে মাথা উঁচু করে ভূমিপুত্রের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই। আমাদের এই অধিকারের শত্রু যারা, আমরা সেই সকল প্রক্রিয়ার ধ্বংস চাই।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS2020.10.20মানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS2020.06.09ফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS2020.05.25ঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS2020.04.19লকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!