বরফ ছাড়া যেমন অ্যান্টার্কটিকা শোভা পায়না, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া যেমন সুন্দরবন মণিহারা ফণী ঠিক তেমনই আতসবাজি ছাড়া অসম্পূর্ণ বাংলার কালী পুজো। বাজির বাজারে এখন দক্ষিণ ভারতীয় থেকে শুরু করে চিনা বাজির রমরমা। কিন্তু এসবের মধ্যেও বাঙালি মনে রেখেছে বুড়ীমাকে। হ্যাঁ, এই বাঙালি ব্যবসায়ীর বাজির রোশনাই আজও হাসি ফোটায় আমাদের মুখে। হাওড়া জেলার বেলুড়ে বুড়িমা সংসারের অভাব অনটনের সঙ্গে যুঝতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন বাজি বানানোর মশলা। অন্নপূর্ণা দাস ওরফে সকলের বুড়িমা ধীরে ধীরে বিখ্যাত হন তাঁর আতসবাজীর জন্য। তার বানানো ‘বুড়িমার চকলেট বোম’ অনেক বাঙালির ছোটবেলার নস্ট্যালজিয়া। তবে পরবর্তীকালে শব্দবাজি নিষিদ্ধ হওয়ায় চকলেট বোম আর বানানো না হলেও বুড়িমার বাজী বাংলা তথা ভারতের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে। ‘এক্সক্লুসিভ অধিরথ’ বুড়ীমার বাজি সাম্রাজ্যের তাদের হাল-হকিকৎ জানতে হানা দিল তাদের আঁতুড়ঘরে। কথা হল বুড়ীমার চতুর্থ প্রজন্ম সুমিত দাসের সঙ্গে। তিনিই মেটালেন আমাদের প্রশ্নের তেষ্টা।
কীভাবে বুড়ীমা গোটা বাংলার বাজি সাম্রাজ্যের বুড়ীমা হয়ে উঠলেন?
বুড়ীমা নামটি এসেছে ওনার চেহারার একটি আদলের জন্য। স্থানীয় লোকজন অসুস্থ হলে তাদের পরামর্শ দিতেন অন্নপূর্ণা দাস। সেই থেকে বুড়ীমা হিসেবে পরিচিতি তাঁর। ১৯৬৫ সাল থেকে তাঁর এই পথচলা। তবে বুড়ীমার চকলেট বোম বাজারে আনেন বুড়ীমার ছেলে সুধীর চন্দ্র দাস। বুড়ীমার এই ছেলেই এই বাজির ব্যবসাকে ব্র্যান্ডে পরিণত করেন। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন বাজির মেলায় স্টল দেওয়া হতো। এছাড়াও বহু জায়গায় চকলেট বোমের নমুনা এবং আমাদের ঠিকানা দিয়ে আসা হতো। সেই নমুনা পছন্দ হলে ঠিকানায় তারা চিঠি পাঠিয়ে দিতেন অথবা সরাসরি আসতেন অর্ডার দিতে।
বুড়ীমার বাজি কেনার জন্য মহালয়া থেকেই লাইন পড়ার কারণ কী? বাজির গুণমান, ব্যবসার স্ট্র্যাটেজি নাকি ‘বুড়ী মা’ এই নামের মাহাত্ম্য?
বাজির গুণমানের কথাই সবার প্রথমে বলতে হবে। আমরা ক্রেতাকে সঠিক দামে সেরা গুণমানটিই দেওয়ার চেষ্টা করি। তাছাড়া বুড়ীমার নাম বাজি-প্রেমীদের মগজে গেঁথে গিয়েছে। এই ব্র্যান্ড সচেতনতাও আমাদের ব্যবসার স্ট্র্যাটেজিকে প্রভাবিত করছে।
এবারের কালীপুজোয় কী কী নতুন বাজি আপনারা উপহার দিচ্ছেন?
শব্দবাজি আইনত নিষিদ্ধ। কাজেই আলোর বাজি বেশি। এ বছর বেরিয়াম নাইট্রেট ছাড়া বেশ কিছু বাজি এসেছে যেখানে দূষণ অনেকটাই কম হয়। ড্রোন বলে একটি বাজি এসেছে যেটি ড্রোনের মতোই আকাশে উঠে দেখাবে রঙের খেলা। একেবারে রকেটের মতো উড়ে যাবে না, নামবে এবং উঠবে ক্রমান্বয়ে। একটি বাক্সে ৫ পিস করে রয়েছে, যার মোট দাম ২৫০ টাকা। নারীর ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি দিয়ে গোলাপি রঙের একটি বাজি বানিয়েছে শিবকাশীর ‘ভানিথা’। আমরা পশ্চিমবঙ্গে সেটির সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছি। এছাড়াও নতুন কিছু ক্র্যাকলিং তুবড়ি এবার আমরা বানিয়েছি যেগুলির প্রতি বাক্স মূল্য ১০০-১২০ টাকা। প্রতি বাক্সে ৫ টি করে রয়েছে তুবড়ি।
শব্দ এবং পরিবেশ দূষণের আঙিনায় দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে বাংলার বাজি-শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
পরিবেশ দূষণ এবং শব্দ দূষণ এই দুটিই বাজির জন্য হচ্ছে। শব্দ বাজি বর্তমানে নিষিদ্ধ এবং আলোর বাজির ক্ষেত্রে দূষণ একেবারেই যাতে কমিয়ে ফেলা যায় তাঁর কথা মাথায় রেখেই শিব কাশীতে একটি বাজি গবেষণা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আপাততঃ সেটি পরীক্ষার জায়গায় থাকলেও আশা করছি এক বছরের মধ্যেই তা বাজারে এনে ফেলা যাবে।
বিদেশে এবং ভিনরাজ্যের মাটিতে বুড়ীমার চাহিদা ঠিক কী রকম?
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ঝাড়খন্ড, বিহার এবং অসমে আমাদের সব থেকে বেশি বাজি বিক্রি হচ্ছে এই মুহূর্তে।
একটা কথা জানিয়ে রাখি। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের বাজির ব্যবসা করায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা মনে করি যেহেতু এতে বারুদের মতো দাহ্য পদার্থ রয়েছে, কাজেই এটি নিষিদ্ধ থাকাই উচিৎ। নয়তো ভারতের বাজির বাজার পুরোটাই চলে যাবে চিনের হাতে।
তার মানে চীন এখনও বাংলা তথা ভারতের বাজির বাজার দখল করতে পারে নি বলতে চাইছেন?
আমরা যারা সরকারী লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যবসায়ী তারা চিনা বাজি রাখিনা। মুম্বই বা দিল্লির দিক দিয়ে চিনা বাজি বাজারে ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা পরামর্শ দিই সস্তা চিনা বাজি না রাখার জন্য। সেগুলি নিষিদ্ধ কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে, গুণমানও আহামরি কিছু নয়। মাত্র ০.৫% পরিমাণ চিনা বাজি এই মুহূর্তে ভারতীয় বাজির বাজারে রয়েছে।
এতোদিনের চলার পথে ‘বুড়ীমা’ বহু কিছু পেয়েছে। আর কিছু পাওয়া বাকি রয়েছে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। প্রচুর অর্থ-সম্মান অর্জন করেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, এ রাজ্যের বাইরেও আমরা প্রচুর সম্মান পাচ্ছি মানুষ চিনছেন আমাদের। বুড়ীমার কাছে এটাই প্রাপ্য ছিল। তার নাম গোটা পূর্ব ভারতে ছড়াতে পেরেছি, এটাই আমাদের কাছে অনেক। আমরা এই কারণে গর্বিত, আর কিছু আমাদের চাওয়ার বাকি নেই।
ভবিষ্যতে অনলাইন বিপণনে আসার পরিকল্পনা রয়েছে?
জানিয়ে রাখি, অনলাইনে বাজির বিক্রি শুরু হয়েছিল ভারতে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই মুহূর্তে তা বন্ধ রয়েছে। অনলাইন বিপণন বাজির ক্ষেত্রে সফল হয়নি। বাজি এমন একটি জিনিস যেটি কিনতে দাদুরা নাতিকে নিয়ে আসেন, বাবা আসেন ছেলেকে নিয়ে। অর্থাৎ তিন প্রজন্ম একসঙ্গেই বেরোন বাজি কিনতে। এটিই কিন্তু বাজি কেনার একটি মজা। সেই মজা অনলাইনে কখনোই পাওয়া যাবে না।
চিত্র ঋণ – চাঁদ কুমার ঘোষ
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS3 months agoমানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS8 months agoফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS8 months agoঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS9 months agoলকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!