কলমে অনুভব স্বপ্নযোদ্ধা (এক রক শিক্ষার্থী)
বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলা সঙ্গীত ও সাহিত্যের জগতে এক নতুন ঝড় তোলা মাধ্যম এসে জাঁকিয়ে বসেছে। একটু একটু করে তারা দখলে আনছে মসনদ। সে এসেছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে। তাই ঘরের ছেলে হয়েও পরের ছেলে হয়ে থাকতে হয়েছে চিরকালই। সইতে হয়েছে হাজারও চোরা অপমান, বিদ্বেষ আরও কতো কী! কিন্তু বাংলা স্বাধীন গানের জগতে পিতৃসম প্রসারে রোজ একটু একটু বেড়ে উঠেছে সে। সে মানে বাংলা রক!
একদল দামাল ছেলে চুল বড়ো রেখে নির্দ্বিধায় যদি বলে ওঠে, “ধর্ষণ হলে চুপ করবো না বস, চিৎকার করবো” তাহলে কি তাকে ‘অবাধ্য’ বলে দাগিয়ে দেওয়া দারুণ কঠিন কিছু? মোটেই নয়! ‘ওদের যে চুল বড়ো বড়ো!’ কিংবা ধরুন যে গানের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘শাসন শুধু ভাষণ নয়, আসল অস্ত্র সমন্বয়’। পাড়ার পলিটিক্যাল জ্যাঠামশাইরা রে রে করে ক্ষেপে উঠলেন এসব শুনেই। সটান বলেই দিলেন “প্রজন্মটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে দিন দিন!” তাঁদের সময় সেসব কী গান ছিলো, বলে শুরু করে দিলেন লিস্ট দেওয়া। অতঃপর মাথা ঝাঁকানো, আড় চোখে তাকানো এসবই হয়ে গেল পোস্ট-মডার্ণ আদিখ্যেতা। এসব গায়ে পড়া সমালোচনা সহ্য করেই বাংলার একদল ছেলেপুলে ঠিক করে রেখেছে তাদের বলতে হবে বিদ্রোহের কথা, আগুনের কথা। যাই হোক, যে যাই বলুক, নিজেদের কথা তারা বলে চলবেই। এই একবিংশ শতাব্দীর বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে না মেনে, বলবো বললেই হলো? বলা চলবে না, বলতে হলে কর্পোরেট হনুর পা, রাজনৈতিক দাদার ঘাড় ( ঘ না গ আপনি নিজে ঠিক করুন ) ইত্যাদি চেটে দিয়ে তাদের বদান্যতায় আপনাকে চালাতে হবে এই মহাযজ্ঞ! কিন্তু এইভাবে তো আর বিপ্লব আসেনা? তবে?
বাংলা গান হয়ে পড়লো স্বাধীন। নিজের মঞ্চ সে নিজেই বাঁধলো, নিজেই ঠুকলো পেরেক। ওদিকে রেডিও স্টেশন সিনেমার টাকায় অদৃশ্য ফ্রিকোয়েন্সিতে বাজিয়ে দিলো বাজারকে। বলে দিলো, ‘বাজাতে রহো!’ বাজারিরা মহাফুর্তিতে শুনতে থাকলো মধ্যরাতে কারা লাটাই ধরে ঘুড়ি ওড়ায় ইত্যাদি ইত্যাদি। রক-কর্মীরা জোট বেঁধে লড়াইয়ে ডাক দিলেন। সেনাপতিরা গীটার কাঁধে তুললেন, রাজা লিখলেন যুদ্ধজয়ের মন্ত্র। দামামা বাজালো ড্রামার, শুরু হলো বাজার বনাম রাজার যুদ্ধ। এতো অবধি গল্পটা মহাকাব্যিক শোনালেও এরপর পুরোটাই যন্ত্রণা বিদ্ধতার গল্প। দাদাগিরি ফলিয়ে ওপচানো ঔদ্ধত্যের সাথে আপোষ না করে রকবাজি চালিয়ে যাওয়ার গল্প! আর আজ এই লেখাটা লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবছি ‘রকবাজি’ টা কারা করে যেন? হালে শোনা যায় রকবাজি করেন উদ্যোক্তারা এবং উপস্থাপক! সে কি কথা?
এই সপ্তাহান্তে রকবাজি ফলাতে ব্যারাকপুরে আয়োজন করা হলো, ‘শহরতলির রকবাজি’। সে বিষয়ে বেশী কথা না বলাই বাংলা রকের পক্ষে সম্মানজনক। কারণ অনুষ্ঠানের শুরুর আগেই শেষ লেখা হয়ে যায়, অথচ নাম দেওয়া হয় ‘রক’ফেস্ট! সেই রক প্রতিযোগিতায় যারা অংশ নেন, তাদের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে স্পষ্ট ফরমান, “মার্কশিট দেখানো যাবেনা”। বাংলা ব্যান্ডের জগতে উনিশ বছর যাবৎ লড়ে যাওয়া, মাটি কামড়ে বাংলা গানের জন্য পড়ে থাকা শিল্পীকে শুনতে হয়, “আপনারা পেমেন্ট পেয়েছেন তো, বেশ! গান গাওয়া যাবেনা।” হ্যাঁ এখানে ‘ঈশান’ ব্যান্ডটির কথা বলছি। দুই দশক ধরে কাজটা কাজের জায়গায় করে আসার যে বাজারী অর্থনীতির বিরুদ্ধাচারণ, সেটি তাঁরা দারুণভাবে করে এসেছেন। বাজারকে পরোয়া না করেও স্বাধীন বাংলা রক করে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে এসেছেন প্রজন্মকে। সেই ‘ঈশান’কেই ডেকে কার্যত গান না গাইয়ে বিদায় করে দেওয়ার মতো দুঃসাহসও ঘটিয়েছে এই বাজারী অর্থনীতির কিছু পুরোধা। এনারা মনে মনে ভেবে নিয়েছেন অথবা মেনে নিয়েছেন যে বাংলা রকটা কেবল টাকা খসিয়েই কিনে ফেলা যায়।
এই ঔদ্ধত্যের জবাব বাংলা ভাষায়, বাংলা রকই লিখে যেতে পারে। এই বাংলা রক কিনে ফেলার দিবাস্বপ্ন কিছু উদ্ধত গন্ডমূর্খের দ্বারাই দেখা সম্ভব। হয়তো তারা দেখতে শুরু করে ফেলেছেন। যেটা তারা দেখছেন না সেটি হল একটি আহত সিংহের গর্জন। অর্থনৈতিক কাঠামোতে রকের থাবা পড়া এরপর সময়ের অপেক্ষা রয়ে গেলো শুধুই। কারণ স্বাধীন শিল্পীদের কাজ মানুষ শুনছেন বলেই তারা ডাক পাচ্ছেন। তাতে একটি সংগঠনের হোতা-মাথার অনুমতি গ্রহণ অপ্রয়োজনীয়! এরা শিল্পীকে শিল্পে বাধা দেন, কিন্তু পাড়া-ভোলানো কৌশলে মানুষ নাচাতে টাকা ঢালেন। যদি আবারও কখনও তারা রকবাজারি করার দুঃসাহস দেখান জবাব না হয় তোলা থাকবে। কিন্তু আপাতত সময়টা একত্রিত চিৎকারের।
এই দামাল রকবাজ ছেলেগুলো শুরু থেকেই জানে যুদ্ধটা কাদের হয়ে এবং কাদের বিরুদ্ধে। আজ মুখগুলো আরও বেশী স্পষ্ট হচ্ছে হয়তো। তাই পায়ের আওয়াজটাও স্পষ্টই হচ্ছে সেই জিতে যাওয়ার দিনটাকে বাস্তব করার জন্য। আজ স্টেজ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে কাল ওই স্টেজ আর প্রয়োজনীয় থাকবে না, কারণ শ্রোতারা শিল্পীদের শোনেন, ক্লাব সেক্রেটারিকে নয়। স্বাধীন বাংলা গান, এই শেকলের আওয়াজ তুলছে কারণ শেকল ভাঙার দিন এগিয়ে আসছে আরো সামনে। আর কর্পোরেট দাদারা, রাজনৈতিক গাধারা সকলেই ভয় পেয়ে আজ কণ্ঠরোধের নেশায় বুঁদ হচ্ছেন। বাজার বনাম রাজার লড়াইয়ে জিতবে রাজাই। শুধু আমি, আপনি, বাংলা রককর্মী ও প্রেমীরা রক্তটা কাদের হয়ে ঝরালাম সেটাই ইতিহাস মনে রাখবে। যতই হোক রক্ত, যতই হোক ‘রক’ তো!
Author Profile

Latest entries
Dating Tips3 months agoThe Ultimate Guide To Online Dating
EXCLUSIVE NEWS12 months agoবাংলার সরকারী পদে রাজ্যের ভূমিপুত্র সংরক্ষণের দাবীতে হুগলি জেলা বাংলা পক্ষ নামল রাস্তায়
EXCLUSIVE NEWS2021.01.05পদ্ম-দুর্গে ঘাসফুলের শিকড় মজবুত করতে যাচ্ছেন অভিষেক, গঙ্গারামপুর স্টেডিয়ামে চলছে শেষ লগ্নের প্রস্তুতি!
EXCLUSIVE NEWS2020.10.13পুজোয় বয়স্করা কীভাবে আটকাবেন মারণ-রোগকে? শ্রীরামপুর আইএমএ দিল তারই হদিশ!