কয়েক দশক আগেও রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সম্পর্কটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাঁরা শুধু ডাক্তারই ছিলেন না, ছিলেন অসুস্থ রোগীর অবলম্বন, ছিলেন মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকা এক বিশ্বস্ত হাত। রাত-বিরেতে হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভরসার আরেক নাম ছিলেন পাড়ার ডাক্তার। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বদলাল এই ছবি। চিকিৎসকদের অস্বাভাবিক আর্থিক চাহিদা, কাটমানি, কমিশনের চক্করে পড়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হতে শুরু করল। উল্টোদিকে অবিশ্বাসের বাতাবরণে একের পর এক ডাক্তার নিগ্রহ, হাসপাতালে ভাঙচুর প্রায় রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। এই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতেই শ্রীরামপুর বইমেলায় ৮ জানুয়ারি বিকেলে হয়ে গেল এক আলোচনা সভা। হাজির ছিলেন ডাঃ কুণাল দত্ত, ডাঃ অনিল সাহা, হাইকোর্টের আইনজীবী সাধন রায়চৌধুরি, সাংবাদিক তমাল সেনগুপ্ত এবং সমাজকর্মী বিবর্তন ভট্টাচার্য প্রমুখ। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী শিল্পী ঘোষ।
শ্রমজীবি হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ কুণাল দত্তের ভাষায়, আজকাল বাজারে গিয়ে ঘটিবাটি বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য কিনতে হয়। ইন্টারনেটে যেভাবে আমরা অনেক কিছু কিনি, ঠিক সেভাবেই স্বাস্থ্য কেনার একটা অভ্যেস শুরু হয়ে গিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সবাই তাদের ছেলেমেয়েদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান। কিন্তু সন্তানকে এই পেশার দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি সমাজের সেবা নাকি এর অর্থকরী দিকটাই আসল কারণ? কুণালবাবুর আক্ষেপ, এক বাণিজ্যিক বিষাক্ত থাবা আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্ততঃ ৪০ বছর ধরে এই বিষময় প্রক্রিয়া চলছে। তাঁর দাবি, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা হু’র ফতোয়ার অন্ধ অনুকরণ না করে আমাদের চিকিৎসার পদ্ধতি আমাদেরই ঠিক করতে হবে। ডাঃ কুণাল দত্তের প্রশ্ন, আজ একজন ডাক্তার রোগীর একটি অসুখের জন্য এতগুলো ওষুধ লিখে দিচ্ছেন কার স্বার্থে? তাঁর আরও অভিযোগ ওষুধ এবং গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরেই রাষ্ট্রের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এই আর্থিক লুটতরাজ চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ পকেট উল্টে উজাড় হয়ে যাবেন।
সমাজকর্মী বিবর্তন ভট্টাচার্য বর্তমান ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক নিয়ে বক্তব্যের শুরুতেই এক সহজ উদাহরণ পেশ করেন। তিনি বলেন, মঞ্চে বসে থাকা অতিথিদের সঙ্গে দর্শকাসনে বসা মানুষের একটা ব্যাবধান থেকেই যায়। তাঁর মতে, চিকিৎসা এখন সেবা নয়, ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দশক আগে টাকার কথা না ভেবেই, শুধু রোগীর টানেই ডাক্তার ১০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে চলে যেতেন। কিন্তু বাণিজ্যিক মনোভাবের কারনে সেই আন্তরিকতা আজ হারিয়ে গিয়েছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক তমাল সেনগুপ্ত বলেন, বর্তমানে প্রাইভেটে ডাক্তার হওয়ার খরচ ১৫ লক্ষ টাকা। সেই টাকা যেন তেন প্রকারেণ ডাক্তারি করেই তুলতে হবে। সর্বত্র দেখা যাচ্ছে এই মানসিকতারই প্রতিফলন। রোগীকে ডাক্তারের ওপর ভরসা করার এবং ডাক্তারকে রোগীকে সম্মান করার নিদান দেন তিনি। অবিলম্বে একটি স্বাস্থ্য আন্দোলনের কথাও তমালবাবু বলেন।
হাইকোর্টের আইনজীবী সাধন রায়চৌধুরি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ভারতে ৯৫% ক্ষেত্রে হাতুড়ে ডাক্তাররাই পরিষেবা দেন। রোগীকে ডাক্তারের কাছে ‘গ্রাহক’ বানিয়ে তুলেছে স্বয়ং রাষ্ট্রই। তবে তলানিতে যাওয়া ডাক্তার এবং রোগীর সম্পর্ক ঠিক হওয়ার ব্যাপারে তিনি যথেষ্টই আশাবাদী।
একটি হাস্য-কৌতুকের আড়ালে বক্তব্য মেলে ধরেন শ্রমজীবি হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ অনিল সাহা। এক ভদ্রলোক ৯০ তলা থেকে মাটিতে পড়ে আঘাত পাওয়ায় তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তারবাবু তাঁকে জানান, যে তিনি ৮০ তলা পর্যন্ত ডাক্তার। তাঁর বেশি উঁচু থেকে পড়ে আঘাত পেলে সেটির চিকিৎসা তাঁর এক্তিয়ারে পড়ে না। অর্থাৎ মানুষের মাথায় জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সামান্য ব্যাপারেও আমার একজন বিশেষজ্ঞ দরকার। অনিলবাবুর অভিযোগ চিকিৎসা পরিষেবা যিনি কেনেন তিনি কোনও অবস্থাতেই দরাদরি করার অবস্থাতেও থাকেন না। তাঁকে দরকারে সর্বস্ব খুইয়ে এটি কিনতে হয়। উল্টোদিকে যিনি এই পরিষেবাটি বিক্রি করেন তিনিই পুরো মূল্য ঠিক করেন। অতীতে ফিরে গিয়ে তিনি বলেন, আটের দশকে জুনিয়র ডাক্তারদের একটি বিশাল আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। জুনিয়র ডাক্তাররা এই আন্দোলন করলেও এটির দাবিগুলি আসলে সাধারণ মানুষের স্বার্থেই ছিল। ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে এক্স-রে, জীবনদায়ী ওষুধের জোগান বজায় রাখার দাবিই এই আন্দোলনের মূলে ছিল। কিন্তু এখন সেভাবে কোনও জোটবদ্ধ প্রতিবাদ না হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থার কারবারিরা ক্রমশঃ মুনাফার পাহাড়ে চড়ছেন। ডাঃ অনিল সাহার আশঙ্কা, চিকিৎসক-ডাক্তার সম্পর্কের আরও অবনতি হবে যদি সাধারণ মানুষ রুখে না দাঁড়ান।
অনুষ্ঠান শেষে সামগ্রিক বক্তব্যের নির্যাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের মধ্যে অভিভাভকত্ব থাকুক, ব্যবসায়ী মনোভাব নয়।
Author Profile

Latest entries
EXCLUSIVE NEWS2020.10.20মানুষের থেকেও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ওরা! ২৫টি কুকুর এবং ৯টি বেড়াল নিয়ে ভরা সংসার যুবতীর!
EXCLUSIVE NEWS2020.06.09ফুটবল স্টেডিয়ামে ৫ মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনেই হল চাকরির পরীক্ষা
EXCLUSIVE NEWS2020.05.25ঈদে চূড়ান্ত সম্প্রীতির নজির ফেসবুক পোস্টে, শুভেচ্ছা বার্তায় আপ্লুত নেট-দুনিয়া
EXCLUSIVE NEWS2020.04.19লকডাউনেও রেশন ডিলারের চুরি, পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় ধরা পড়লো অভিযুক্ত!