ছত্তিশগড়ের আদিবাসী অধ্যুষিত বস্তার জেলার একটি ছোট্ট শহর জগদলপুর। চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এই সুন্দর শহরটির আনাচে কানাচে ইতিহাস কথা বলে। অনেকের কাছেই হয়তো এই ইতিহাস অজানা। জগদলপুরের বস্তার প্যালেস নিয়ে দু’চার কথা আজ আপনাদের বলবো। জগদলপুর শহরের মাঝখানে বেশ কয়েক বিঘে জমির উপর আজও স্বমহিমায় দণ্ডায়মান বস্তার প্যালেস। প্যালেসে ঢোকার আগে, চলুন একটু ইতিহাস পরিক্রমা করে আসি। চালুক্য ও কাকাতীয় রাজবংশের বিভিন্ন রাজারা একসময় এই বস্তারে রাজত্ব করতেন। ১৪২৪ শতাব্দীতে কাকাতীয় রাজা প্রতাপরুদ্রের ভাই অন্নমাদেব অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারাঙ্গল থেকে বস্তারে এসে রাজত্ব স্থাপন করেন। পরবর্তী কয়েকশো বছর ধরে কাকাতীয় বংশের রাজারা রাজত্ব করেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন হামির দেও, প্রতাপরাজ দেও, রাজপাল দেও ও দলপত দেও। ১৯৬৬ সালে এই বংশের মহারাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জ দেও আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়াই করেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন তিনি। তাঁর নাতি কমল চন্দ্র ভঞ্জদেও বর্তমানের মহারাজ। এই হল এই স্থাপত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।
সেই ইতিহাসের সাক্ষী হতে আমিও গিয়েছিলাম জগদলপুরের রাজমহল দর্শনে। তখন সময়টি ছিল নবরাত্রী ও দশেরার। ১০ দিন ধরে রাজবাড়ি আম জনতার জন্য খুলে দেওয়া হয়। রেওয়াজ অনুসারে, আশেপাশের গ্রাম থেকে সব আদিবাসীরা কিছু না কিছু ভেট নিয়ে আসেন রাজদর্শনে। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গেলাম রাজমহলের দিকে। নীল রঙের বর্ডার দেওয়া দুধ সাদা মহলের পরতে পরতে। মনে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করছি। রাজাকে সামনা সামনি দেখবার সৌভাগ্য হবে, সে কি চাট্টিখানি কথা? ইতিহাস আজও কথা বলে। কতো রাজকীয় ঘটনা, ষড়যন্ত্র, উৎসবের সাক্ষী এই মহল। রাজার রাজত্বের সঙ্গে সেই গৌরবও আজ শুধুই অতীত। মহলের বেশ কিছু অংশ ভাড়া দেয়া হয়েছে স্থানীয় দোকানপাট ও অফিসকে। বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকে, কয়েকটি সিড়ি দিয়ে উঠে সামনেই দেখি বিশাল হলঘরে রাজদরবার। কাঠের সুন্দর কাজ করা সিংহাসনে বসে আছেন বর্তমান রাজা। বয়েস বড়জোর ১৫ কি ১৬ হবে। । কোমলতা মাখানো মুখে সবে গোঁফ উঠেছে। পরনে রাজপোষাক এবং মাথায় রাজমুকুট। দুপাশে দুজন অভিজ্ঞ দর্শন ব্যক্তি সম্ভবত অভিভাবক স্থানীয় কেউই হবেন। সামনের দেয়ালে একটি বাঘের মাথা আর দু’দিকের দেয়ালে টাঙানো শিংওয়ালা হরিণের মাথা। চারদিকে পূর্ব পুরুষদের বড় বড় তৈলচিত্র আঁকা। বুঝলাম সিংহাসনে আসীন কিশোরটিই বর্তমান রাজা কমল চন্দ্র ভঞ্জদেও। আদিবাসীরা একে একে নিজের ক্ষেতের সব্জি, ফল; কেউ বা মিষ্টিও নিয়ে আসছেন সঙ্গে ভেট হিসেবে। রাজার চরণে তা নিবেদন করে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন। কি অদ্ভুত সরলতা ভরা নিষ্পাপ মুখগুলো আর সেইসঙ্গে কি অসীম রাজভক্তি। এই আনুগত্য ওঁদের কৃতজ্ঞতার নিদর্শন; ওঁদের হকের জন্য যে লড়াই করেছিলেন বর্তমান রাজার পূর্ব পুরুষ।
মহল থেকে বেরিয়ে, উদ্যান-পথ ধরে ফেরার সময়ে হতশ্রী, রুক্ষতায় ছাওয়া উদ্যানটি দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল একসময় এই উদ্যানে কত রং বেরংয়ের বাহারি ফুলের সমারোহ ছিল। এই উদ্যান মুখরিত ছিল পাখিদের কলতানে। কালের স্রোতে এভাবেই হয়তো মানুষের হৃদয় থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং আনুগত্য।
মহলটিকে ফিরে দেখলাম শেষবারের জন্য। কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল মন। রাজমহলটি তার আভিজাত্য ও গৌরব হারিয়ে হয়ে পড়েছে কিছু মানুষের পয়সা উপার্জনের উপায়। সময়ের চাকা কি ভাবে ঘুরে যায় তা যথার্থ বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায়। মনে হল যেন তারই এক নিদারুণ নিদর্শন পিছনে ফেলে আসা ওই রাজমহলটি।
Author Profile
